এবার ঢাকার বনানীতে আগুন, নিহত কমপক্ষে ১৯
2019.03.28
ঢাকা

রাজধানীর বনানীতে ফারুক রূপায়ণ (এফ আর) টাওয়ার নামক এক বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাত আটটা পর্যন্ত ১৯ জনের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এর মধ্যে একজন শ্রীলঙ্কার নাগরিক।
এ ছাড়া আহতের সংখ্যা ৭০ এবং অনেকে নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্থাপিত ফায়ার সার্ভিসের কন্ট্রোল রুম।
বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কামাল আতাতুর্ক এই ভবনটিতে আগুন লাগে। পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের এক মাস পার না হতেই ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে ঘটনা ঘটলো। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন।
ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট কয়েক ঘণ্টার চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সন্ধ্যার পরে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরে প্রবেশ করার পরই একের পর লাশ বের হতে থাকে।
এখন পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ডে নিহত সাতজনের পরিচয় জানা গেছে। এরা হলেন পারভেজ সাজ্জাদ (৪৭), আমেনা ইয়াসমিন (৪০), আবদুল্লাহ আল মামুন (৩৬), শ্রীলঙ্কার নাগরিক নিরস চন্দ্র (২৬), আবদুল্লাহ আল ফারুক (৩২), মাকসুদুর রহমান (৬৬) ও মনির (৫০)।
নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকারীরা।
প্রাণ বাঁচাতে লাফিয়ে পড়ে মানুষ
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এফআর টাওয়ারের আশে পাশে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি। ভবনটির উপরের তলাগুলোতে আটকা পড়া মানুষ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের কাছে কাছে প্রাণ বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছেন। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীরা ভবনটির দুপাশ থেকে পানি ছিটাচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন তলায় আটকে পড়া মানুষদেরও উদ্ধার করছে।
তবে জীবন বাঁচাতে বেশ কয়েকজনকে ওপর থেকে লাফিয়ে পড়তে দেখা যায়। অনেকে বিদ্যুতের তার বেয়ে নামতে গিয়েও পড়ে যান।
এফআর টাওয়ারের উল্টো পাশে পার্ক প্লাজা ভবনের ১১ তলায় চাকরি করে ওয়েসকুরুনী প্রিন্স। তিনি বেনারকে বলেন, এফআর টাওয়ারের ১৩-১৪ তলা থেকে ছয়জন মানুষকে লাফ দিতে দেখেছি। সেই দৃশ্য ছিল অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। কারণ অত উপর থেকে লাফ দিয়ে কারও পক্ষে বাঁচা সম্ভব না।”
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশিদ-উন-নবী বেনারকে জানান, যে শ্রীলঙ্কার নাগরিকের মারা যান তিনি অগ্নিকাণ্ডের পর ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়। এ ছাড়া আরও ৩৯ জনকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।”
তিনি জানান, হাসপাতালে যারা ভর্তি রয়েছেন তাঁদের অবস্থা গুরুতর নয়। বেশির ভাগের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা। অন্তত একদিন হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে তাদের।
এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইউনাইটেড হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে আহতরা চিকিৎসাধীন রয়েছে।
জানা যায়, নিহত নিরস চন্দ্র শ্রীলঙ্কার প্রতিষ্ঠান স্কেন ওয়াল লজিষ্টিকে কাজ করতেন। দুর্ঘটনার সময় নিরসের মা ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বনানীর বাসায় ছিলেন। সাত মাস আগে বাবাকে হারান নিরস চন্দ্র।
মরদেহ নিতে শুক্রবার কলম্বো থেকে ঢাকায় আসছেন তার শাশুড়ি পোন্নামা নীরজা, স্কেন ওয়াল লজিস্টিকের এম ডি এন্ডি এন্ডারসন সহ কয়েকজন কর্মকর্তা।
নিখোঁজদের সন্ধানে হাসপাতালে স্বজনেরা
কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে স্বামীকে খুঁজতে আসেন অ্যানী আক্তার পলি নামে একজন নারী।
তিনি বেনারকে জানান, এফআর টাওয়ারের স্কেন ওয়াল নামে এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন তার স্বামী মির্জা আতিকুর রহমান। বেলা দেড়টার দিকে তিনি স্ত্রীকে ফোন করে আগুন লাগার কথা জানান। এরপর থেকে তাকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরেও স্বামীর সন্ধান পাননি পলি। কলি নামে স্বামীর আরেকজন সহকর্মীকেও পাওয়া যাচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, “অনেকেই এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। বিভিন্ন দিক থেকে তথ্য আসছে। এদের অনেককে বিভিন্ন হাসপাতালে পাওয়া যাচ্ছে। অনেকের আবার খোঁজ মেলেনি। আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।”
অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না
এফআর টাওয়ারে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না বলে অভিযোগ করেন ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিলীপ কুমার ঘোষ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ভবনটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। একটি বাণিজ্যিক বহুতল ভবনে যে পরিমাণ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা প্রয়োজন তা সেখানে ছিল না। তবে দু-একটা ফ্লোরে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল।
ফায়ার সার্ভিস আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করায় ভবনটির চারটি ফ্লোরের বাইরে আগুন ছড়াতে পারেনি বলেও জানান তিনি।
“তবে আগুনের ধোঁয়া ওই ভবন ও আশপাশে ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। অনেকে লাফ দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। ফলে হতাহতের ঘটনা ঘটে,” বলেন দিলীপ কুমার ঘোষ।
এদিকে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলেও জানান দিলিপ কুমার ঘোষ।
আগুন লাগার পর এফআর টাওয়ারের ১৪ তলা থেকে পাশের বিল্ডিং হয়ে বের হয়ে আসেন সাব্বির আলী মৃধা নামে একজন ব্যক্তি। তিনি বেনারকে বলেন, আগুন লাগার পরে আমরা ছাদে চলে যাই। সেখান থেকে লাফ দিয়ে পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদে আসি।
তিনি বলেন, “আমি অনেক বছর ধরে এই ভবনের একটি অফিসে চাকরি করি। এ বিল্ডিংয়ে কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না।”
ভবনটির সিঁড়ি মাত্র তিন ফুট
২২ তলাবিশিষ্ট এফআর টাওয়ারের সিঁড়ির প্রশস্ততা মাত্র তিন ফুট জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম।
ঘটনাস্থলে এসে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “এত বড় বড় ভবনে ওঠা-নামার জন্য মাত্র ৩৬ ইঞ্চি আয়তনের সিঁড়ি থাকবে তা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এখন থেকে প্রতিটি ভবনকে যথাযথ কমপ্লায়েন্স হতে হবে।”
পানির সংকট নিয়ে তিনি বলেন, “আগুন নেভাতে পানির সংকট দেখা দিয়েছিল। তারপরও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছেন।”
এফআর টাওয়ারে ভিভিড হলিডেস নামক একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন তানজীব নূর। আগুন লাগার পরে বেরিয়ে তিনি উদ্ধার কাজে অংশ নেন। পরে বেনারকে তিনি বলেন, “ভবনটির ইমারজেন্সির দরজা বন্ধ ছিল। ফলে মানুষ বের হতে পারেনি। আমরা অনেক চেষ্টা করে থাই গ্লাস ভেঙে বের হয়ে আসি।”