সার্বিক অবহেলার ফল বনানী অগ্নিকাণ্ড
2019.03.29
ঢাকা

ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানীর ফারুক রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড সামগ্রিক অবহেলার ফল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর ঘটনাকে গাফিলতি নয় বরং হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করেছেন খোদ গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম। দায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে এ ঘটনায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে ২৫ জনে পৌঁছেছে। আর আহত হয়েছেন ৭৩ জন।
শুক্রবার বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মুশতাক হোসেন। এ ঘটনায় আর কেউ নিখোঁজ নেই উল্লেখ করে তিনি জানান, নিহতদের ২৪ জনের মৃতদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
শুক্রবার দুপরে আগুনে পোড়া এফআর টাওয়ার পরিদর্শনের পর গণপূর্তমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে এটা অবহেলার কারণে দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যাকাণ্ড।”
“জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, তিনি যত প্রভাবশালীই হোন,” বলেন তিনি।
তবে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব মনে করেন, “পুরোপুরি জবাবদিহিতাহীন সরকারি অব্যবস্থাপনার বলিদান এফ আর টাওয়ার।”
সাথে সাথে মালিকপক্ষ এবং ভবনটিতে বসকারীদেরও দোষারোপ করেন তিনি।
ইকবাল হাবিব বেনারকে বলেন, “কোনো ভবন ১০ তলার উপর হলেই তার অগ্নিনিরাপত্তা, অগ্নিনির্বাপণ এবং অগ্নিসতর্কতা থাকতে হবে নিজের সক্ষমতায়। সেসব দেখভাল করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কেউ দায়ভার নেয়নি। আর যারা বসবাস করে তারাও সচেতন নয়।”
এই স্থপতি বলেন, “এফআর টাওয়ার নির্মান হয় ১৯৯৬ সালে। এরপর ইমারত নির্মান বিধিমালা আধুনিকায়ন হয়েছে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড তৈরি হয়েছে। সমস্ত কিছুর আদলে ভবনটি হয়েছে কিনা কেউ সেটা পরীক্ষা করে দেখেনি।”
রাজউক সূত্রে জানা যায়, কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ের ৩২ নম্বর হোল্ডিংয়ে ইঞ্জিনিয়ার ফারুক নামে এক ব্যক্তির জমিতে এই বাণিজ্যিক ভবন তৈরি করে রূপায়ন গ্রুপ।
পুলিশ, মন্ত্রী, ফায়াস সার্ভিস, বিশেষজ্ঞরাসহ বিভিন্ন মহল ভবন মালিককে দোষারোপ করলেও এ পর্যন্ত এ বিষয়ে তাঁদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এছাড়া ভবন মালিককে শনাক্ত করা হলেও তাদের সাথে এখনও যোগাযোগ হয়নি বলেও উল্লেখ করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে বনানীর কামাল আতাতুর্ক রোডের এই ভবনটিতে আগুন লাগে। কয়েক ঘণ্টার চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন।
তলাশ্লি শেষে শুক্রবার ভবনটি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার শাহজাহান সিকদার। তিনি বলেন, “বেলা ১টার দিকে সার্চ অপারেশন শেষ করেছি। ভবনটিতে নতুন করে আগুন লাগার কোনো আশঙ্কা নেই।”
ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, ভবনের সপ্তম, অষ্টম ও নবম তলা একেবারে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
তবে ঠিক কীভাবে এবং কোন তলা থেকে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ভবনের সপ্তম তলায় শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগে। এটা তদন্তের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে।”
এ অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর চারটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
প্রশ্নবিদ্ধ রাজউক
এফ আর টাওয়ার ভবনটি তৈরির সময় ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা হয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী বি. জে. মুহাম্মদ যুবায়ের সালেহীন।
বিষয়টি স্বীকার করে গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমও বলেন, “১৯৯৬ সালে রাজউক ১৮ তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিল। তবে ২০০৫ সালে দাখিল করা একটি নথিতে দেখানো হয় ভবনটি ২৩ তলা। কিন্তু ভবনটি ২৩ তলা কীভাবে হলো তার সমর্থনে কোনো কাগজপত্র রাজউকের রেকর্ডবুকে নেই।”
এই অনিয়মের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তির মুখোমুখি করা হবে বলেও জানান মন্ত্রী। রাজউকের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী।
শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পরে তিনি বলেন, “ভবনটি ১৮ তলা হওয়ার কথা। অথচ হয়েছে ২৩ তলা। সেটাও ১৪ বছর হলো। তাহলে গত ১৪ বছরে রাজউক কী করেছে?”
এই ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মামলা না করলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে বলে জানান জাবেদ পাটোয়ারী।
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, এফআর টাওয়ারে অনেকগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় থাকলেও ভবনটিতে পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা ছিল না। আর যেটুকু ছিল, সেগুলোও কার্যকর ছিল না। ভবনটিতে কোনো জরুরি নির্গমন সিঁড়িও ছিল না।
বহুতল ভবন যাচাই হবে
এদিকে বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর এবার রাজধানীর বহুতল ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না, তা যাচাই করে দেখার হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “ঢাকায় যে বহুতল ভবনগুলো আছে প্রত্যেকটি বিল্ডিংয়ে তাদের ফায়ার সেফটি এবং বিল্ডিং সেফটির যত ধরনের পারমিশন, সব কিছু আগামী ১০ দিনের মধ্যে আমাকে দিতে হবে।”
এ বিষয়ে জনস্বার্থে নোটিস দেওয়া হবে বলে জানিয়ে মেয়র বলেন, “নোটিস দেওয়ার পর ম্যাজেস্ট্রেট পাঠাব। যারা ফায়ার সেফটি নিয়ে তারা কাজ করেনি, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেব।”