বনানী অগ্নিকাণ্ড: ভবন নির্মাণের অনিয়মে জড়িত ছিলেন রাজউকের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা

পুলক ঘটক
2019.05.22
190522_FR_tower_story_1000.JPG ঢাকার বনানীর এফ আর টাওয়ারে লাগা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন দমকল বাহিনীর সদস্যরা। এই অগ্নিকাণ্ডে ২৭ ব্যক্তির নির্মম মৃত্যু হয়। ২৮ মার্চ ২০১৯।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

গত মার্চে ঢাকার বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে নিহত হন ২৭ জন, আহত হন আরো অনেকেই। এবার তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ওই ভবনটি নির্মাণে বহুমাত্রিক ত্রুটি–বিচ্যুতি ছিল। আর এসব অনিয়মের পেছনে যুক্ত ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেমসহ অর্ধশতাধিক প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারী।

পৃথক তদন্তের মাধ্যমে এসব ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং রাজউক। বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন দুটির মূল অংশ তুলে ধরেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার ৮৪ শতাংশ বহুতল ভবনই ত্রুটিপূর্ণ।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী রেজাউল জানান “অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সংশ্লিষ্ট আবাসন প্রতিষ্ঠানসহ সবার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে এমন অপরাধ বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. এ কে এম আবুল কালাম বেনারকে বলেছেন, “সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে ঢাকা মহানগরীতে মানুষের জীবন ও সম্পদ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।”

“অপরাধমূলক দুর্ঘটনা থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইন প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। অনিয়ম রোধে নজরদারি জোরালো করা দরকার,” বলেন তিনি।

গত ২৮ মার্চ এফ আর টাওয়ারে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডে ২৭ ব্যক্তির নির্মম মৃত্যু হয়। আহত হন আরও অনেকে। ওই দুর্ঘটনার পর রাজউক এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটি তদন্ত কমিটি করেছিল। দুই কমিটির প্রতিবেদন একসঙ্গে বুধবার প্রকাশ করা হলো।

ঢাকার ৮৪ শতাংশ বহুতল ভবন ত্রুটিপূর্ণ

গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এই তদন্তে রাজধানী ঢাকার ভবন নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকার প্রায় ৮৪ শতাংশ বহুতল ভবনই ত্রুটিপূর্ণ। বিধি-বিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে অধিকাংশ ভবন।

গত ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর ১ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত রাজউকের আটটি জোন থেকে ২৪টি টিম গঠন করে বহুতল ভবন (১১ তলার ওপরে) পরীক্ষা করা হয়।

এ সময় পরিদর্শক দল ঢাকায় এক হাজার ৮১৮টি ভবন পরীক্ষা করে। এর মধ্যে ৪৩১টি ভবনের অনুমোদিত নকশাই নেই। শুধু বেসরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবন নয়, ৪৪টি সরকারি ভবনের নকশা দেখাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

পরিদর্শনকৃত ভবনের মধ্যে মাত্র ২৯৩টি ভবন অনুমোদিত নকশা মোতাবেক নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন গণপূর্তমন্ত্রী।

বাকি এক হাজার ৫২৫টি বহুতল ভবনই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে, যা পরিদর্শন করা ভবনের প্রায় ৮৪ শতাংশ।

অনুমোদিত নকশা ছাড়াও আগুন নেভানোর ব্যবস্থা ও অগ্নি নির্গমন সিঁড়ি না থাকা এবং ত্রুটিপূর্ণ সিঁড়িসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যত্যয় ও ত্রুটি পাওয়া গেছে এসব ভবনে।

রাজউকের ২৪ দলের তদন্তে সবচেয়ে বেশি অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায়।

পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বেনারকে বলেছেন, “রাজউক এবং সিটি করপোরেশনের গঠিত বিভিন্ন কমিটি এর আগে অনেকগুলো সুপারিশ দিয়েছে। সরকারের উচিত সুপারিশ অনুযায়ী দ্রুত অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা।”

“এসব অ্যাকশন প্ল্যান কত দিনের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়েও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা থাকা আবশ্যক। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে একটি ফাইনান্সিয়াল প্ল্যানও করা প্রয়োজন,” মনে করেন তিনি।

দায়-দায়িত্ব নিরূপণ

রাজউকের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এফআর টাওয়ারের ১৮তলা বিশিষ্ট আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ভবনের নকশা অনুমোদন বিধি লঙ্ঘন করে করা হয়েছে। এই অনুমোদনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে।

শ. ম রেজাউল করিম বলেন, “তদন্তে রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে পরিদর্শক পর্যন্ত যারা ছিলেন, যারা ঋণ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন তাঁদের সকলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই ঘটনায় জড়িত। তাঁদের সকলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

মন্ত্রী বলেন, “তদন্তে অনেকগুলো অনিয়ম শনাক্ত হয়েছে, সব মিলে আমরা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছি তাঁদের অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ নেই।”

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, “বেআইনিভাবে এফআর টাওয়ারের নকশা অনুমোদনের জন্য তৎকালীন রাজউকের চেয়ারম্যান হুমায়ুন খাদেম এবং ওই প্লটে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) অনুমোদিত উচ্চতা (১৫৫ ফুট) নির্ধারিত থাকার পরও ১৯৩ ফুট উচ্চতার ১৮তলা ভবনের অনুমোদন দেওয়ার জন্য অথরাইজড অফিসার সৈয়দ মকবুল আহম্মেদ ও তার কমিটি দায়ী।

এফআর টাওয়ারের ভূমির মালিকের দায় রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮ তলার ঊর্ধ্বে নির্মিত অবৈধ অংশটি অপসারণের জন্য রাজউককে তিনি লিখিতভাবে অনুরোধ জানালেও পরবর্তীতে অবৈধভাবে নির্মিত অংশের অংশের সুবিধা ভোগ করেছেন তিনি।

প্রতিকারমূলক সুপারিশ

তদন্ত কমিটি প্রতিকারমূলক সুপারিশে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে। অনুমোদিত উচ্চতার অতিরিক্ত অংশ ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এফআর টাওয়ারের অবৈধ নকশা অনুমোদনে সহায়তাকারী হিসেবে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত অথরাইজড অফিসার সৈয়দ নাজমুল হুদা, সহকারী অথরাইজড অফিসার মো. বশির উদ্দিন খান এবং রূপায়ন হাউজিং এস্টেট লিমিটেডের ভবন নির্মাণকাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির স্বাক্ষর বিশেষজ্ঞ দ্বারা শনাক্ত করে মামলা করার সুপারিশও করেছে কমিটি।

সংবাদ সম্মেলনে গণপূর্তমন্ত্রী বলেন, “প্রাথমিকভাবে বহুতল ভবন পরিদর্শন করা হয়েছে। আমরা সকল বিল্ডিং পরিদর্শন করব এবং ব্যবস্থা নেব।”

মন্ত্রী বলেন, “নির্দিষ্ট সময়ে নকশা প্রদর্শনে ব্যর্থ ভবনের বিরুদ্ধে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ব্যত্যয়কৃত ভবনের অনিয়মকৃত অংশ ভেঙে ফেলার জন্য আমরা নির্দেশ দেবো। ভেঙ্গে না ফেললে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।