ভারত–বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘নতুন উচ্চতায়’ নিতে চান হাসিনা ও মোদি
2018.08.31
ঢাকা

বাংলাদেশের সন্ত্রাস বিরোধী অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সব ধরনের সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী অর্থায়নের বিরুদ্ধে সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বানের মধ্য দিয়ে শুক্রবার নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে চতুর্থ বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো–অপারেশন (বিমসটেক) শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেন। পরে তিনি সাইডলাইনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে সাক্ষাত করেন।
উন্নয়নের স্বার্থে একসাথে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করে বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যমান বন্ধুত্বকে ‘নতুন উচ্চতায়’ নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী।
বিশ্লেষকদের মতে, ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হাসিনা-মোদি বৈঠক থেকে দুদেশের সম্পর্ক ভবিষ্যতে ‘নতুন উচ্চতায়’ নেওয়ার এই ঘোষণা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
দ্বিতীয় দিন শুক্রবার যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়। যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বিমসটেক নেতারা যে দেশেই হোক না কেন সব ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের নিন্দা জানান।
বিবৃতিতে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অর্থায়ন বন্ধ করতে ও সন্ত্রাস ঠেকাতে, সন্ত্রাসীদের নতুন নিয়োগ ও সীমান্তে সন্ত্রাসীদের অবাধ চলাচল বন্ধ করতে, সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য ধ্বংস করতে ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ইন্টারনেটের অপব্যবহার ঠেকাতে সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
বৃহস্পতিবার তাঁর বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সব ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে।
উল্লেখ্য, এবার সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল—‘টু্ওয়ার্ডস এ পিসফুল, প্রসপারাস অ্যান্ড সাসটেইনবেল বে অব বেঙ্গল রিজন’।
হাসিনা-মোদি সাক্ষাত
হোটেল সোয়ালটি ক্রাউন প্লাজায় অনুষ্ঠিত হাসিনা-মোদি দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বেনারকে বলেন, “দুই প্রতিবেশি দেশের জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে দুই প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যতে একযোগে কাজ করে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।”
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থনের জন্য ও বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে প্রেস সচিব আরো বলেন, “আমরা বিদ্যমান সম্পর্ককে ভবিষ্যতে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের ব্যাপারে আমাদের রাজনীতিতে কৌতূহল আছে।
তিনি বলেন, “সারাবিশ্বে দেখা যায় যে, শক্তিধর কোন প্রতিবেশি রাষ্ট্র সামরিকভাবে অথবা রাজনৈতিকভাবে দূর্বল দেশের রাজনীতির ওপর একটি প্রভাব রাখে। আমাদের দেশও এর ব্যাতিক্রম নয়।”
তাঁর মতে, সাধারণত এ ধরনের সাইডলাইন মিটিংয়ে সিরিয়াস রাজনৈতিক বিষয়গুলো আলোচনা হয় না। তবে রাজনৈতিক বিষয় যে আলোচিত হবে না তাও বলা যায় না।
ড. রহমান বলেন, “আমাদের জাতীয় নির্বাচন আসন্ন। বলা যায়, ভারত আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করবে। কারণ, আওয়ামী লীগ তার শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে ২০০৯ সাল থেকে ভারতকে ভূ–রাজনৈতিকভাবে সহযোগিতা করে আসছে। তারা চাইবে না অন্য কোন সরকার এসে এই অঞ্চল অস্থিতিশীল করে তুলুক।”
পররাষ্ট্র বিশ্লেষকদের মতে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মধ্যে প্রধান সমস্যা ছিলো ভারত-বিরোধী সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠিকে আশ্রয়-প্রশয় দেওয়া।
ওই সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যকে ভারত থেকে আলাদা করতে চায়।
বাংলাদেশের সামরিক শাসক ও অন্য সরকারগুলোর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীদের সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ ছিল।
তবে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় শেখ হাসিনার সরকার। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া নেতারা পালিয়ে যায়। আবার অনেককে গ্রেপ্তার করে ভারতের হাতে তুলে দেয় বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের সন্ত্রাস বিরোধী অবস্থানের কারণে ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে ভারতের সামরিক ব্যয় কমেছে ব্যাপকভাবে। নিরাপদ হয়েছে ভারতের অখণ্ডতা।
এ বছর ৩০ মে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা ভারতকে যেটা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে। প্রতিদিনের বোমাবাজি, গোলাগুলি থেকে আমরা তাদের শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছি। এটা তাদের মনে রাখতে হবে।”
ড. আতাউর রহমান বলেন, “গত এক দশকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক তিক্ত হয়নি। সে কারণেই বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে যাচ্ছে। বড় প্রতিবেশীর সাথে তিক্ত সম্পর্ক হলে উন্নয়ন হয় না।”
তিনি বলেন, “দেশের শান্তি ও উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনা যা যা করা দরকার তাই করেছেন, যদিও ভারত বাংলাদেশকে প্রতিদানে তেমন কিছুই দেয়নি। কিন্ত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক তিক্ত হয়নি।”
বৃহস্পতিবার সকালে বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী সাত দেশের জোট বিমসটেকের চতুর্থ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে নেপালের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নেপালের উপ-প্রধানমন্ত্রী ঈশ্বর পোখারেল এবং নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানান ।
বিমানবন্দর থেকে প্রধানমন্ত্রীকে মোটর শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হয় কাঠমান্ডুর হোটেল সোয়ালটি ক্রাউনি প্লাজায়।
বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী সাত দেশের একটি অর্থনৈতিক জোট বিমসটেক। বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা ও থাইল্যান্ড ১৯৯৭ সালে ব্যাংকক ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই জোটের সূচনা করে। পরে মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান বিমসটেকে যোগ দেয়।
ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছে বিমসটেক, কাজ করছে সার্ক ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতার একটি সেতুবন্ধন হিসেবে।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক ও সে দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতা অং সান সূ চি এই এই শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেননি। তাঁর পরিবর্তে যোগ দেন মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট।