রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ভোলা শান্ত
2019.10.21
ঢাকা

ফেসবুকে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে ‘অবমাননাকর’ বক্তব্য ছড়ানোর জের ধরে ভোলায় পুলিশ–জনতা সংঘর্ষে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ওই ঘটনার ধারাবাহিকতায় স্থানীয় হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বাসা-বাড়িতে হামলার অভিযোগ করেছেন সংখ্যালঘুদের সর্ববৃহৎ সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ।
সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত সোমবার বেনারকে বলেন, “ ভোলার বোরহানউদ্দিনে পাঁচ-ছয়টি মন্দির এবং আট-নয়টি বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।”
এ ছাড়া চট্টগ্রামের হাটহাজারীত সংখ্যালঘুদের তিনটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও একটি মন্দিরে হামলা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
এর আগে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ তুলে এক হিন্দু তরুণের শাস্তির দাবিতে ‘মুসলিম তৌহিদি জনতা’ ব্যানারে প্রতিবাদ প্রদর্শনকারীদের সাথে পুলিশের মধ্যে রোববার দেশের একমাত্র দ্বীপজেলায় ওই সংঘর্ষ ঘটে।
তবে এবার আতঙ্ক কিছুটা কম বলে মনে করেন রানা দাশগুপ্ত।
তিনি বলেন, “কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর বা অন্যান্য এলাকায় এ জাতীয় ঘটনার পর বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা যতটা আতঙ্কিত হয়েছে, এবার ততটা হয়নি। কারণ ওই সব ঘটনায় সরকার নিশ্চুপ থাকলেও এবার এবার প্রথমবারের খোদ প্রধানমন্ত্রীসহ প্রশাসন ও পুলিশের যথেষ্ট ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।”
বোরহানউদ্দিন এবং হাটহাজারীতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ প্রতিনিধি দল পাঠাবে বলেও তিনি জানান।
উল্লেখ্য, ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামু উপজেলায় হামলা চালিয়ে লুটপাটসহ ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে রসরাজ নামে এক হিন্দু মৎস্যজীবীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ এনে হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলা চালানো হয়।
ভোলায় ১৪৪ ধারা
এদিকে ভোলায় সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ মুসল্লিদের সমাবেশ ঠেকাতে সোমবার স্থানীয় সরকারি কলেজ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারির পাশাপাশি পুরো জেলা শহরে সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেন, “কেউ যেন প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের সভা সমাবেশ বা মিছিল না করে, সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।”
অন্যদিকে সমাবেশ করতে না পেরে সংবাদ সম্মেলন করে ছয়দফা দাবি জানিয়ে সরকারকে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয় বিক্ষোভকারীরা।
“সমাবেশ স্থগিত করেছি। তবে আমরা যে ছয় দফা দাবি দিয়েছি, তা আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাস্তবায়ন করা না হলে কঠোর কর্মসূচি দেব,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক এবং ভোলা জেলা ইমান আক্বিদা সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি মাওলানা বশির উদ্দিন।
এরই প্রেক্ষিতে জেলা সার্কিট হাউজে পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক ডিআইজি শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, “আমাদের নির্দিষ্ট বিভাগ তাদের দাবিগুলো খতিয়ে দেখছে।”
হিন্দু তরুণের আইডি হ্যাক হওয়ার সত্যতা যাচাইয়ে পুলিশের বিশেষজ্ঞ টিম ফেইসবুকের সঙ্গে আলোচনা করবে বলেও তিনি জানান।
অন্যদিকে বিকেলে ঢাকার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান, “ফেসবুকের সিঙ্গাপুর অফিসের সাথে যোগযোগ করা হয়েছে। দুই-একদিনের মধ্যে প্রকৃত তথ্য বেড়িয়ে আসবে।”
এর আগে রোববারেই ভোলার ঘটনায় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ধৈর্য ধারণ ও গুজবে কান না দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বোরহানউদ্দিনে পুলিশ ও বিজিবির পাশাপাশি কোস্টগার্ড সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন, সাংবাদিকদের বলেন পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার।
পাশের জেলা থেকে দুইশ’র বেশি পুলিশকে ভোলায় আনা হয়েছে বলে জানান ভোলা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এনায়েত হোসেন।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
পুলিশ বলছে, বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য শুভ নামের এক যুবক শুক্রবার রাতে বোরহানউদ্দিন থানায় গিয়ে একটি জিডি করেন। সেখানে তিনি তার ফেইসবুক আইডি হ্যাকারের কবলে পড়ার কথা জানান। তিনি থানায় থাকাকলীন হ্যাক হওয়া আইডি ফেরতের বিনিময়ে অর্থ চেয়ে তাঁর মোবাইলে কল করে মুসলমান এক যুবক।
তবে শুভর মেসেঞ্জার থেকে মহানবীকে (সা.) নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য’ ছড়িয়ে সেই ‘স্ক্রিনশট’ (প্রতিলিপি) ব্যবহার করে গত শুক্রবার থেকে বোরহানউদ্দিনে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয়। তাঁর বিচারের দাবিতে বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ ময়দানে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।
দফায় দফায় সংঘর্ষে চারজন নিহত হন, পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজিসহ আহত হন শতাধিক ব্যক্তি। নিহতরা হলেন- বোরহানউদ্দিন উপজেলার মহিউদ্দিন পাটওয়ারীর মাদরাসাছাত্র মাহবুব (১৪), উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের দেলোয়ার হোসেনের কলেজপড়ুয়া ছেলে শাহিন (২৩), বোরহানউদ্দিন পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাহফুজ (৪৫) এবং মনপুরা হাজিরহাট এলাকার বাসিন্দা মিজান (৪০)।
পুলিশ সদর দফতরের দাবি, সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশের দিকে গুলিও ছোড়া হয়; তাতে একজন পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। সংঘর্ষে যে চারজন নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে দুজনের মাথা ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে থেঁতলানো ছিল বলেও চিকিৎসকের বরাতে জানিয়েছে পুলিশ।
সংঘর্ষে আহত ৪১ জনকে ভোলা সদর হাসপাতাল এবং ৩০ জনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বাকিদের বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। আহতদের বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “প্রাথমিকভাবে জানা গেছে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছে। তবে এ ঘটনায় পুলিশ কিংবা অন্য কারও দায়িত্বে অবহেলা আছে কি না সে বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তে কারও অবহেলা প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
এ ছাড়া সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ভোলার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) শেখ সাব্বির হোসেন।
এক মামলায় পাঁচ হাজার আসামি
সংঘর্ষের ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয়ের পাঁচ হাজার লোককে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। বোরহানউদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ম. এনামুল হক জানান, থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবিদ হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
“হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা, বিশৃঙ্খলার অভিযোগে এই মামলা হয়েছে। তবে আমরা এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করিনি,” সোমবার দুপুরে বেনারকে বলেন তিনি।
এর আগে শুভর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাককারী ও তার মোবাইলে কল দিয়ে টাকা চাওয়ায় শরীফ এবং ইমন নামে দুই যুবককে যথাক্রমে পটুয়াখালী এবং বোরহানউদ্দিন থেকে আটক করে পুলিশ।
এ ছাড়া ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনজনের বিরুদ্ধে একই থানায় আরেকটি মামলা করা হয়েছে। আসামিরা হলেন; বিপ্লব চন্দ্র শুভ, ইমন ও শাকিল।
আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে পুলিশ আসামিদের পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেছে। পরবর্তী শুনানির দিনে এ আবেদনের ওপর শুনানি হবে।
নতুন কর্মসূচি
ভোলায় সংবাদ সম্মেলনে মুসল্লিদের নেতা মাওলানা বশির উদ্দিন বলেন, মঙ্গলবার ভোলার প্রতিটি থানায় বিক্ষোভ মিছিল করবেন এবং বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলা সদরে মানববন্ধন করবেন তারা । এ ছাড়া শুক্রবার বিকেলে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহতদের জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করবে ‘সর্বদলীয় মুসলিম ঐক্য পরিষদ’।
এ সময় ছয় দফা দাবি ঘোষণা করে ঐক্য পরিষদ ও ঈমান আক্বিদ্বা সংরক্ষণ কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান।
দাবিগুলো হচ্ছে, যে যুবকের ফেসবুক আইডি থেকে ‘অবমাননাকর’ বক্তব্য এসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তার ফাঁসি কার্যকর, সংঘর্ষে নিহতদের লাশ বিনা ময়নাতদন্তে পরিবারের কাছে হস্তান্তর, আহতদের সরকারি খরচে চিকিৎসা, ভোলার পুলিশ সুপার ও বোরহানউদ্দিনের ওসিকে প্রত্যাহার, নিহতদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও গ্রেপ্তারদের বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়া।
ঢাকায় বিক্ষোভ
বোরহানউদ্দিনে চার ব্যক্তি হত্যার প্রতিবাদে সোমবার ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে ইসলামী আন্দোলন ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর প্রাঙ্গণে সংগঠন দুটি পৃথক বিক্ষোভ ও সমাবেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির দাবি জানান সংগঠন দুটির নেতারা।
এ ছাড়া বোরহানউদ্দিনে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মঙ্গলবার সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।
এদিকে ভোলায় হতাহতের প্রতিবাদে বুধবার সারা দেশে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।