সব খোলা রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় সমালোচনা

জেসমিন পাপড়ি
2022.02.03
ঢাকা
সব খোলা রেখে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় সমালোচনা করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে মুখে মাস্ক পরে স্কুলে যাচ্ছে ঢাকার তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। করোনাসংক্রমণ এড়াতে টানা দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর কিছুদিন খুলে দিলেও আবার স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ১১ জানুয়ারি ২০২২।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

দেড় বছরের বেশি সময় টানা বন্ধ থাকার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেও আবার ছুটির ফাঁদে পড়েছে দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী। নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম মাস পার হলেও শুরু হয়নি লেখাপড়া। চলতি মাসের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে বৃহস্পতিবার আবারও প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।

করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে বিধিনিষেধ চলমান থাকলেও সেসবের তোয়াক্কা না করে জনজীবন স্বাভাবিক গতিতেই চলছে। এমন অবস্থায় শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাঁরা বলেছেন, ইউনেস্কো এবং ইউনিসেফের আহ্বানের পরেও যে কয়েকটি দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ তাদের মধ্যে একটি। সব শিক্ষার্থীর জন্য টিকাদান এবং বিকল্প পাঠদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত বোধগম্য নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বেনারকে বলেন, “করোনার কারণে দীর্ঘ দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বড়ো গ্যাপ তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে অটো প্রমোশন দেয়া হলো। সেসব শিক্ষার্থীর আবার কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা নিয়ে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট দেয়া হলো।”

“এর ফল এখন থেকে ৪-৫ বছর পরে পাওয়া যাবে। এসব শিক্ষার্থী যখন কর্মজীবন বা উচ্চ শিক্ষা নিতে যাবে, তখন তারা অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতা নিয়ে উপরে যাবে,” বলেন তিনি।

এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার পক্ষে মত দেন অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান।

তিনি বলেন, “করোনার ঊর্ধ্বগতির জন্য স্কুল বন্ধ রাখাটা ঠিক আছে মানলাম। কিন্তু শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আর বাকি সব খোলা রেখে তো করোনার সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব না। এর জন্য মানুষকে মাস্ক পরে বের হতে বাধ্য করার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।”

কোভিডের সাথে মানিয়েই জীবন শুরু করতে হবে

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “স্কুল-কলেজ বন্ধ হলেও কওমি বা হাফিজিয়া মাদ্রাসা বন্ধ করা হয়নি। আবার করোনা নিয়ন্ত্রণে যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে সেগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোথাও পালন করতে দেখা যায়নি।”

“এর মধ্যে বাণিজ্যমেলাসহ নানা ধরনের মেলা চলেছে, রাস্তাঘাটসহ সকল স্থানে ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। তাই শুধু স্কুল-কলেজ বন্ধ করে করোনা কতটা নিয়ন্ত্রিত হলো, সেটা বলা না গেলেও শিক্ষা যে সীমাবদ্ধ হলো সেটা বলা যায়,” যোগ করেন তিনি।

“মনে রাখতে হবে কোভিডের সাথে মানিয়ে নিয়েই আমাদের নতুন জীবন শুরু করতে হবে। ইউনিসেফ এবং ইউনেস্কোও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার আহবান জানিয়েছে। তাই শিক্ষার্থীদের দুই ডোজ টিকা দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত,” বলেন ডা. লেলিন চৌধুরী।

শিক্ষার ক্ষতির দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, “এটি না করলে শিক্ষাজনিত যে বিরাট ক্ষতির মধ্য দিয়ে আমরা গেছি বা যাচ্ছি তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকা আছে। দিনে আমরা ৭০ লক্ষ টিকা দিতে পারি সে সক্ষমতাও আমাদের আছে। তারপরেও কেন সকল শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনা যাচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলী আর রাজী বেনারকে বলেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় লেখাপড়াসহ শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। তবে এই ক্ষতি মানুষের জীবনের মূল্যের চেয়ে বেশি কি না বা সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা যেটুকু আছে তার জন্য বিপদজনক হয়ে দাঁড়াবে কিনা সেটা সরকার গঠিত জাতীয় কমিটি ভালো বলতে পারবেন।”

এই বিশেষজ্ঞ কমিটিতে সমাজ বিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী থাকার দরকার ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই কমিটি কাদের নিয়ে গঠিত এবং তাঁরা শিক্ষার্থীদের বিষয়টা বিবেচনায় নিচ্ছেন কিনা সেটা বারবার পরীক্ষা করার দরকার আছে।”

২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের পর সেবছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রাখা হয় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর বেশ কয়েকবার সম্ভাব্য তারিখ জানানো হলেও করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ছুটি বাড়ানো হয়। এভাবে একটানা টানা দেড় বছর পরে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে খুলে দেয়া হয়। ফলে দীর্ঘদিন পর শ্রেণিকক্ষে ফেরে শিক্ষার্থীরা।

কিন্তু গত নভেম্বরে করোনাভাইরাসের নতুন ধরণ অমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের মধ্যেই ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশেও অমিক্রন আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে। নতুন এই ধরনের দাপটে এ বছরের শুরু থেকেই দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে।

সংক্রমণ ঠেকাতে ১০ জানুয়ারি ১১ দফা নির্দেশনা জানিয়েছে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। গত ২১ জানুয়ারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির ঘোষণা আসে। এ ধাপে প্রথমে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই সপ্তাহ বন্ধ থাকার কথা জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

তবে বৃহস্পতিবারের প্রজ্ঞাপনে আরো ২ সপ্তাহ বা ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও সমমান প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

বিধি নিষেধের মেয়াদও বেড়েছে

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানের পাশাপাশি জনসমাগমে বিধিনিষেধের মেয়াদও আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার।

করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব এবং বাংলাদেশে এখনকার সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার এ সিদ্ধান্ত দিয়েছে বলে বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়।

সেখানে বলা হয়, “আগের জারি করা সব বিধিনিষেধ ও নির্দেশনার সঙ্গে দুটি শর্ত সংশোধন করে সার্বিক কার্যাবলী/চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলো। এই বিধিনিষেধ আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত বলবত থাকবে।”

সংশোধিত শর্ত দুটি হল; উন্মুক্ত স্থানে ও ভবনের ভেতরে সামাজিক/রাজনৈতিক/ধর্মীয়/রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে একশো জনের বেশি সমাবেশ করা যাবে না। এক্ষেত্রে যোগদানকারীদের অবশ্যই কোভিড টিকা সনদ বা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পিসিআর পরীক্ষার সনদ আনতে হবে। এবং সব স্কুল-কলেজ ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বন্ধ থাকবে।

একদিনে করোনায় মৃত্যু ৩৩, শনাক্ত কমেছে

দেশে টানা ৫ দিন করোনায় ৩০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় আক্রান্ত ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া একই সময়ে ১১ হাজার ৫৯৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় ৩৬ জনের মৃত্যু ও নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল ১২ হাজার ১৯৩ জন।

এই নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১৮ লাখ ৩৫ হাজার ৭৭৬ জন। আর মারা গেছেন ২৮ হাজার ৪৯৪ জন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।