'আমি সু্স্থ' বলে দেশ ছাড়লেন প্রধান বিচারপতি

প্রাপ্তি রহমান
2017.10.13
ঢাকা
অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য ঢাকার হেয়ার রোডের বাসা থেকে বের হওয়ার পর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে ঘিরে ধরেন গণমাধ্যমকর্মীরা। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার জন্য ঢাকার হেয়ার রোডের বাসা থেকে বের হওয়ার পর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে ঘিরে ধরেন গণমাধ্যমকর্মীরা। ১৩ অক্টোবর ২০১৭।
ফোকাস বাংলা

দেশ ছাড়ার আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা জানিয়েছেন, তিনি সুস্থ আছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বিব্রত হওয়ার কথা জানান।

গতকাল শুক্রবার রাত ১০টায় ঢাকার হেয়ার রোডের বাসা থেকে বের হওয়ার পথে ফটকের বাইরে উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন। এরপর লিখিত বক্তব্যের একটি কপি সাংবাদিকদের দিয়ে গাড়িতে উঠে বিমানবন্দরের পথে রওনা হন তিনি।

গত সপ্তাহে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান বিচারপতি ক্যান্সারে আক্রান্ত। তাঁর এই বক্তব্যের পর সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী আইনজীবীরা পরষ্পরবিরোধী অবস্থান নেন। বিরোধী দল বিএনপি বলে আসছে, প্রধান বিচারপতি অসুস্থ নন। গতকাল প্রধান বিচারপতি নিজেই সুস্থ থাকার কথা জানিয়ে দেশ ছাড়লেন। বললেন, তিনি ফিরে আসবেন।

ছুটিতে থাকা প্রধান বিচারপতি সিনহা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে ঢাকার হেয়ার রোডের বাসা থেকে বেরোনোর সময় স্ত্রী সুষমা সিনহা তার সঙ্গে ছিলেন। তবে বিমানে উঠেননি তিনি।  রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে প্রধান বিচারপতি একাই অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন।

তাঁর বিদেশ যাত্রার খবর সংগ্রহের জন্য গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে হেয়ার রোডের বাসভবনের সামনে গণমাধ্যম কর্মীরা জড়ো হন। সেই সঙ্গে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন উপস্থিত ছিলেন।

রাত ১০টায় প্রধান বিচারপতি বাসা থেকে বের হন। গাড়িবহরে প্রধান বিচারপতির সরকারি গাড়ি ছাড়াও আরও তিনটি প্রাইভেট কার ছিল। গাড়িবহরের আগে পিছে ছিল পুলিশের দুটো পিকআপ ভ্যান।

প্রধান বিচারপতির হেয়ার রোডের বাসভবনের প্রাঙ্গণ ঘুরে গাড়িবহরটি যখন ফটক দিয়ে বেরিয়ে যায় তখন গাড়ি থামিয়ে পেছনের সিট থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। তাঁর পরনে ছিল ছাই রঙে​র স্যুট। উপস্থিত সংবাদকর্মীদের উদ্দেশ্যে হাত তুলে তাঁদের নীরব হওয়ার ইঙ্গিত করেন প্রধান বিচারপতি।

“আমার কথা শোনেন, আমার কথা শোনেন। কিছুই হয়নি। আমি অসুস্থ না। আমি ভালো আছি। আমি পালিয়েও যাচ্ছি না। আমি আবার ফিরে আসব। আমি একটু বিব্রত। বিচার বিভাগের আমি অভিভাবক। বিচার বিভাগের স্বার্থে, বিচার বিভাগ যাতে কোনোভাবে কলুষিত না হয় এ জন্যই আমি সাময়িকভাবে যাচ্ছি। আমার কারও প্রতি কোনো বিরাগ নেই,” বলেন প্রধান বিচারপতি।

এস কে সিনহা বলেন, “আমার দৃঢ় বিশ্বাস সরকারকে ভুল বোঝানো হয়েছে...”

এরপর প্রধান বিচারপতি নিজের প্যাডে লেখা ও সই করা লিখিত বক্তব্যের একটি কপি গণমাধ্যম কর্মীদের হাতে দিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশে গাড়িতে উঠে বসেন।

লিখিত বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, “আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি, কিন্তু ইদানীং একটা রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের মাননীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সরকারের একটি মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস।”

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। এর দৃষ্টান্ত তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, “গতকাল (বৃহস্পতিবার) প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন।”

এ প্রসঙ্গে এস কে সিনহা বলেন, “প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধুমাত্র রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটিই হয়ে আসছে। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি হবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।”

গত ২৭ আগস্ট থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটি চলাকালীন প্রধান বিচারপতি ছুটিতে বিদেশ সফর করেন। এরপর দেশে ফেরেন। গত ২ অক্টোবর এক মাসের ছুটিতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেন প্রধান বিচারপতি। পরে তিনি ১৩ অক্টোবর বা কাছাকাছি সময়ে বিদেশে যাওয়া এবং ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, প্রধান বিচারপতির ছুটির মেয়াদ আগামী ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বেড়েছে। এ জন্য ১০ নভেম্বর বা তিনি দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করবেন।

এর আগে গত ১ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন দলীয় নেতা, মন্ত্রী ও সরকার সমর্থক আইনজীবীরা।

এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। গত প্রায় আড়াই মাস ধরে রায়টি​ ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে। এটি রিভিউ করার জন্য ইতিমধ্যে রায়ের ৭৯৯ পৃষ্ঠার অনুলিপি তুলেছে সরকারপক্ষ।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি জাতীয় সংসদ, সাংসদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, দশম জাতীয় সংসদসহ বেশকিছু বিষয়ে যেসব মন্তব্য করেন, তা সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের বিব্রত করে। একজন প্রধান বিচারপতি এসব বিষয়ে মন্তব্য করতে পারেন না বলে মত আসতে থাকে। এমন অভিযোগও ওঠে যে, প্রধান বিচারপতি বিরোধী দল বা অন্য কোনও মহলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।