রংপুরের নিখোঁজ আইনজীবী রথীশের লাশ উদ্ধার
2018.04.04
ঢাকা

নিখোঁজ হওয়ার পাঁচ দিন পর নির্মাণাধীন এক বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হলো আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিকের মরদেহ, যিনি রংপুরে জঙ্গি গোষ্ঠীর হাতে নিহত জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ছিলেন।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) জানায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে সহধর্মিণী স্নিগ্ধা সরকার দীপা ও তার সহকর্মী কামরুল ইসলাম চাঞ্চল্যকর এই হত্যার কথা স্বীকার করেছে।
এর আগে শুক্রবার দীপা ও পরিবারের সদস্যরা থানায় করা সাধারণ ডায়েরিতে জানান, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য ও রংপুর জেলার আইনজীবী রথীশচন্দ্র (৫৮) শুক্রবার সকাল ছয়টার দিক থেকে নিখোঁজ রয়েছেন।
তিনি সকাল ছয়টার দিকে রংপুর শহরের তাজহাটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটি মোটরসাইকেলে চেপে চলে যান, এরপর থেকে আর বাসায় ফিরে আসেননি বলে ডায়েরিতে উল্লেখ করা হয়।
হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি, জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করতেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে জামায়াতে ইসলামী কিংবা জঙ্গি গোষ্ঠী কিংবা ভূমিদস্যুরা রথীশকে ধরে নিয়ে গেছে বলে আশঙ্কা করেছিলেন ট্রাস্টের নেতারা। এ নিয়ে গত পাঁচদিন রংপুরসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বিক্ষোভ–সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
নিখোঁজের পর থেকে রথীশচন্দ্রকে উদ্ধারের দাবিতে রংপুর শহরসহ সারা দেশে গণ-অনশন ও মানববন্ধন করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা। আগামী শনিবার সড়ক অবরোধেরও ঘোষণা দেয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ, যা গতকাল স্থগিত করা হয়েছে।
কীভাবে হত্যাকাণ্ড?
রথীশচন্দ্র ভৌমিকের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে জঙ্গি গোষ্ঠীকে দায়ী করে আসছিলেন তাঁর পরিবার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা।
তবে লাশ উদ্ধারের পরে বুধবার র্যাব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ রংপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, সংসারের ‘অশান্তি, অবিশ্বাস ও পরকীয়ার’ বলি হয়েছেন রথীশচন্দ্র ভৌমিক।
র্যাব মহাপরিচালক বলেন, শুক্রবার সকালে নয়, বৃহস্পতিবার রাতেই রথীশচন্দ্র ভৌমিককে হত্যা করে তার সহধর্মিণী দীপা এবং তার শিক্ষক সহকর্মী ও প্রেমিক কামরুল ইসলাম।
কামরুল ও দীপা উভয়েই তাজহাট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ছিলেন রথীশ।
লিখিত বক্তব্যে র্যাব জানায়, গত বৃহস্পতিবার আনুমানিক রাত ১০টা দিকে শোয়ার ঘরে রথীশকে ভাত ও দুধের সঙ্গে ১০টি ঘুমের বড়ি খাওয়ানো হয়। ঘুমের বড়ি খাওয়ানোর পর অচেতন হয়ে গেলে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। হত্যার পর রাতে মৃতদেহ শোয়ার ঘরেই রেখে দেওয়া হয়।
বেনজীর আহমেদ জানান, এরপর শিক্ষক কামরুল পরদিন শুক্রবার ভোর পাঁচটায় রথীশের বাড়ি থেকে বের হন। সকাল নয়টায় তিনি একটি ভ্যান নিয়ে আসেন।
র্যাব জানায়, লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে নিহত ব্যক্তির স্ত্রী তাঁর প্রেমিকের সহায়তায় একটি আলমারি পরিবর্তনের নাম করে সেই আলমারিতে লাশ ভরে নিয়ে তাঁদের বাড়ি থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে শহরের তাজহাট মোল্লাপাড়া এলাকায় একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে বালু খুঁড়ে পুঁতে রাখেন। আলমারিটি বহন করে ভ্যানে তোলার কাজে নিয়োজিত তিন ব্যক্তিকেও কামরুল ঠিক করেন।
হত্যাকাণ্ডটির পরিকল্পনা দুই মাস আগে করা হয় জানিয়ে বেনজির আহমেদ বলেন, ঘটনার মূল দায়ী কামরুল মাস্টারকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। কামরুল মাস্টারের দুই ছাত্র তাকে সহায়তা করেছে। তারাও আমাদের হেফাজতে আছে।”
আটক ছয়
রথীশচন্দ্র হত্যার ঘটনায় তাঁর সহধর্মিণী দীপা ও মেয়েসহ মোট ছয়জনকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছে বলে জানান র্যাব মহাপরিচালক।
রথীশের ভাই, দৈনিক খোলা কাগজের রংপুর বিভাগীয় অফিসের প্রধান সুশান্ত ভৌমিক সুবল বেনারকে জানান, তার পরিবার দীপার পরকীয়ার কথা জানত না।
“আমরা মনে করি র্যাব যা বলছে সেটা ঠিক। আমরা প্রথমে মনে করেছিলাম জঙ্গিরা এটার সাথে জড়িত। কিন্তু না। আমার বৌদি আমার ভাইকে হত্যা করেছেন। আমি রংপুরে কমিউনিটি পুলিশিং করে কত মানুষের ঘর বাঁচিয়েছি। আর আজ আমাদের ঘর ভাঙল? বলার কিছু নাই,” বলেন সুবল।
দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, “সংসার ভালো না লাগলে উনি চলে যেতে পারতেন। তাই বলে হত্যা করতে হবে?”
হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারেন এমন সন্দেহে, মঙ্গলবার দুপুর থেকে রথীশের বাড়ির পাশের ডোবাটিতে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। রাতে ডোবায় তল্লাশি অভিযান স্থগিত রাখা হয়।
নিখোঁজ রথীশচন্দ্রকে উদ্ধারে পুলিশের পাশাপাশি তদন্তে নামে র্যাবও।
পরে র্যাব তাজহাটে অভিযান চালিয়ে কামরুলের ভাইয়ের নির্মাণাধীন বাড়িতে একটি লাশ উদ্ধার করে। সেখানে দীপা ও নিহতের ভাই সুবলকে নেওয়া হলে রথীশের লাশ শনাক্ত করেন সুবল।