পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে বোমা বানাতে গিয়ে ৮ জনের মৃত্যু
2017.04.21
কলকাতা

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর থানার দরবারপুর গ্রামে বোমা বানাতে গিয়ে আট জনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ঘটনাটি ঘটেছে শুক্রবার বিকেলের দিকে। আহত চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জানিয়েছেন।
বীরভূমের পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার সাংবাদিকদের বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে আমরা জেনেছি এটা দু’টি দুষ্কৃতকারী দলের লড়াই। তারই প্রস্তুতি হিসেবে বোমা তৈরির কাজ চলছিল। হঠাৎ বোমা ফেটে দুর্ঘটনাটি ঘটে। ঘটনাস্থলেই চারজনের মৃত্যু হয়। আর চার জনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।
লাভপুর থানার পুলিশ জনিয়েছে, ওই বিস্ফোরণে আনোয়ার শেখ (৪২), রমজান শেখ (৪৫), আদু শেখ (৪৮), লালসাদ শেখ (৪৬), হাসিবুর শেখ (৪০), কালো শেখ (৩৫), আসাদুল শেখ (৩৭) এবং জামিরুল শেখ (৪৫) নিহত হয়েছে।
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, বালিঘাটের দখল নিয়ে দুই দল বালি মাফিয়ার মধ্যে লড়াই চলছিল বেশ কয়েকদিন ধরে। খাদান থেকে বালি তোলাকে কেন্দ্র করে শুক্রবারও দুই দলের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয় পাশের দ্বারকা গ্রামে। ফলে এলাকার একমাত্র স্কুলটিও বন্ধ করে দিতে হয়।
এরপর আরও বোমা জোগাড় করতেই দুষ্কৃতীরা দরবারপুরে আসে। গ্রামের বাইরে বাগদিপাড়ায় বোমা বাঁধার সময়েই হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি ঝলসানো দেহ ছড়িয়ে রয়েছে। অনেকের হাত-পা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। পুলিশ এসে স্থানীয় মানুষের সহায়তায় ছিন্নভিন্ন দেহ এবং আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যায়।
পুলিশ জানিয়েছে, দিন কয়েক আগেই দ্বারকা পঞ্চায়েতের এই দরবারপুর থেকেই তিন ড্রাম ভর্তি শতাধিক তাজা বোমা তারা উদ্ধার করেছিল। এ ছাড়া মাসখানেক আগে বালির ঘাটের দখল নিয়ে এই পঞ্চায়েতেরই সাওগ্রামে লখরিদ শেখ নামে একজনকে বোমা মেরে খুন করেছিল দুষ্কৃতীরা।
স্থানীয় মানুষ অভিযোগ করেছেন, শাসক দলের মদদপুষ্ট বালি মাফিয়াদের বালি ঘাটের কর্তৃত্ব দখলের পরিণতিতেই এতজনের মৃত্যু হয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বেনারকে বলেছেন, এই ঘটনার সঙ্গে তাঁদের দলের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর অভিযোগ, অবৈধ বালি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সবাই সিপিআইএম আশ্রিত দুষ্কৃতকারী।
তবে সিপিআইএম জেলা কমিটির সদস্য পল্টু কোঁড়া অভিযোগ খারিজ করে সাংবাদিকদের বলেন, “ওই গ্রামে তো আমাদের দলের সংগঠনই নেই। তৃণমূলের দু’টি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বকে আড়াল করতেই এই দোষারোপ করা হচ্ছে।”
নদীর বালি খাদান দখলের লড়াই
বীরভূম ও বর্ধমান জেলার নানা জায়গায় পারমিটের ভিত্তিতে বালি তোলার পাশাপাশি অবৈধভাবে নদীর বুক থেকে বালি তোলার কাজ চলছে অনেকদিন ধরে। বীরভূম জেলাতেই ময়ূরাক্ষী ও অজয় নদীর আশপাশে প্রায় ৮০টি অবৈধ বালি খাদান রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন জেলার পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা।
এর থেকে পারমিটের ভিত্তিতে বালি তোলার ব্যবস্থা থাকলেও তাদের আরও অভিযোগ, এই বালি খাদান থেকে বছরে আয় হয় ৭০ কোটি রুপির ওপর। আর তাই এই বালি খাদানের ওপর নিয়ন্ত্রণের জন্য শাসক দলের আশ্রিত দুষ্কৃতীদের মধ্যে লড়াই লেগেই রয়েছে।
বীরভূমের এক সাবেক শিক্ষক হরিপদ মণ্ডল বেনারকে জানিয়েছেন, শহরে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা যত ফুলে ফেঁপে উঠছে ততই বাড়ছে বালির চাহিদা। আর সেই বালির কারবার চালাচ্ছে একদল রাজনৈতিক মাফিয়া। তিনি বলেন, বীরভূম থেকে বালি কলকাতার নিউটাউন, বর্ধমানের দুর্গাপুরে ও আসানসোল, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রশাসনের নাকের ডগায়।
সিপিআইএমের সাবেক সাংসদ রামচন্দ্র ডোম সাংবাদিকদের বলেছেন, এই অবৈধ বালি খাদান শুধু যে আইন শৃঙ্খলার সমস্যা তৈরি করছে তাই নয়, শাসক দলের গোষ্ঠী সংঘর্ষেরও অন্যতম কারণ এটি।
গোষ্ঠী সংঘর্ষের দায় নেবে কে
শুক্রবার লাভপুর থানার অধীনে যে ঘটনা ঘটেছে তার জন্য স্থানীয় মানুষ দায়ী করেছেন শাসক দলের দুই গোষ্ঠীর লড়াইকে। অভিযোগ, দরবারপুরের শোয়েব আলি এবং মীর বাঁধের আহাদুর শেখের দলবলের মধ্যে বেশ কিছু দিন ধরেই বিরোধ চলছিল। শুক্রবার তা চরমে পৌঁছায়।
পশ্চিমবঙ্গের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, অবৈধ বালি খাদান বন্ধ করতে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। ইতিমধ্যেই নিয়মিত নজরদারি শুরু হয়েছে।
তবে বালি মাফিয়ারা যে শাসক দলের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে তা এক তৃণমূল কংগ্রেস নেতা বেনারকে বলেছেন। তিনি বলেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বালি খাদান নিয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেবার নির্দেশ দিতে হয়েছে।
তবে সিপিআইএম বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী বলেন, দুষ্কৃতীদের সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আর তারই পরিণতিতে ভয়াবহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
উল্লেখ্য, এই জেলারই পাশের জেলা বর্ধমানে ২০১৪ সালে একটি বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে দুজন জঙ্গির মৃত্যু হয়েছিল। সেই ঘটনার বিচার এখনও শুরু না হলেও এনআইএ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে। এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে আটজন।