পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় কেন্দ্র-রাজ্য বিরোধ তুঙ্গে
2021.06.03
কলকাতা

পশ্চিমবঙ্গে ভোটপর্বে তৃণমূল কংগ্রেসের সাথে হেরে যাওয়া কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপির যে সংঘাতের আবহ তৈরি হয়েছিল, নির্বাচন শেষে তা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসবে—এমনটাই ভেবেছিলেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। কিন্তু ভোট-পরবর্তী গত এক মাসের ঘটনাপ্রবাহ কার্যত কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত আরো তীব্র করে তুলেছে।
সর্বশেষ রাজ্যের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত মুখ্যসচিব ও শীর্ষস্থানীয় আইএএস কর্মকর্তা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কেন্দ্র সরকারের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণকে কেন্দ্র করে এই বিরোধ তুঙ্গে ওঠে।
ওই ঘটনায় সাবেক একাধিক আমলা ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র এবং রাজ্যের অধিকারের সীমারেখা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। কারণ কেন্দ্রের নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা নিযুক্ত করেছেন মমতা।
“একে নজিরবিহীনই বলব। আমার ৩৬ বছরের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতায় এমনটি শুনিনি। করোনা ও সাইক্লোনে বিধ্বস্ত একটি রাজ্যের মুখ্যসচিবকে তাঁর অবসর গ্রহণের দিন, তাঁর ও রাজ্যের সম্মতি ছাড়াই দিল্লিতে পদবি ছাড়াই রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে,” বেনারকে বলেন কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের প্রাক্তন সচিব ও প্রখ্যাত লেখিকা অনিতা অগ্নিহোত্রী।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে আট দফায় অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা হয়েছিল মে মাসের শুরুতে। এতে ভোট হওয়া ২৯২টি আসনের মধ্যে ২১৩টি পেয়ে টানা তৃতীয়বারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজেপি পেয়েছে ৭৭টি আসন।
মোদির সফর ও মুখ্যসচিব-বিতর্ক
প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার উপকূলে আছড়ে পড়ে গত ২৬ মে সকালে। ইয়াসে ঝড়বৃষ্টি এবং সাগরের জলোচ্ছ্বাসে পূর্ব মেদিনীপুর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণাসহ পশ্চিমবঙ্গের আরো দশটি জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, যার পর্যালোচনা করতে ২৮ মে রাজ্যে আসেন মোদি।
এ উপলক্ষে কলাইকুণ্ডা বিমান ঘাঁটিতে আয়োজিত প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও আমন্ত্রিত ছিলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়, দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান ও দেবশ্রী চৌধুরী এবং বিধানসভার বিরোধী দলনেতা বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী।
মুখ্যমন্ত্রী ওই দিন রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন সাইক্লোন-বিধ্বস্ত এলাকা পরিদর্শনে বের হন। কলাইকুণ্ডা বৈঠকে মুখ্যসচিবকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে দেড় মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে আসেন।
পরের দিন সামাজিক মাধ্যমে সম্প্রচারিত এক সাংবাদিক বৈঠকে মমতা দাবি করেন, দীঘাতে পূর্বনির্ধারিত প্রশাসনিক বৈঠক থাকায় তিনি কলাইকুণ্ডায় বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়েই বেরিয়ে এসেছিলেন।
তবে বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী ২৮ মে দিল্লি ফিরে যাবার পরেই রাতে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে একটি নির্দেশনামা জারি করা হয়। এতে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে ৩১ মে সকাল দশটার মধ্যে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মীবর্গ ও প্রশিক্ষণ দপ্তরে রিপোর্ট করতে বলা হয়।
আলাপনের চাকরির মেয়াদ সেদিনই শেষ হবার কথা থাকলেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রাজ্য সরকারের আবেদনের ভিত্তিতে গত ২৪ মে তাঁর মেয়াদ আরো তিন মাস বাড়ায় কেন্দ্র সরকার।
রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে আলাপনকে এভাবে দিল্লিতে তলবের নির্দেশে ক্ষুব্ধ হন মমতা। ২৯ মে এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই নির্দেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানান তিনি।
একই সাথে ২৮ মে-র ঘটনার বিবরণ দিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাবের অভিযোগ তোলেন।
তার পরদিন ৩০ মে, মমতা প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়ে দেন, রাজ্য সরকারের তরফে আলাপনকে দিল্লিতে যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে না। চিঠিতে মমতা দাবি করেন, কেন্দ্রের নির্দেশনামা শুধু অসাংবিধানিকই নয়, দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোরও বিরোধী।
রাজ্যের প্রাক্তন আমলারা এই বিতর্কে রাজ্য সরকারের পাশেই দাঁড়িয়েছেন। অনিতা অগ্নিহোত্রীর মতে, আইএএস-এর মতো সর্বভারতীয় সার্ভিসে নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় সরকার, কিন্তু রাজ্যে কাজ করার সময় আধিকারিকরা রাজ্য সরকার বা ক্যাডার কন্ট্রোলিং অথরিটির অধীনে থাকেন।
তিনি বলেন, রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়া তাঁদের কেন্দ্রের অধীনে নিয়োগ করা যায় না। আবার রাজ্য সরকারও কেন্দ্রে নিযুক্ত কোনো আধিকারিককে একতরফা ডাকতে পারেন না।
“তবে অনেক সময় কেন্দ্রীয় সরকার সন্তুষ্ট না হলে কোনো আধিকারিককে রাজ্যে ফেরত পাঠাতে পারেন, কিন্তু উল্টোটা সম্ভব নয়। এ সবই আইএএস সার্ভিস রুলে নির্দিষ্ট করা আছে। এখানে কোনো ধোঁয়াশা নেই,” যোগ করেন অনিতা।
এদিকে নাটকীয় পরিস্থিতিতে ৩১ মে মুখ্যসচিব আলাপন চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধিতে অসম্মত হয়ে অবসর গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন, রাজ্যের প্রয়োজনে আগামী তিন বছর আলাপন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করবেন।
মমতা বলেন, ‘‘আলাপন অবসর নিলেন। তাঁর আজই অবসর নেওয়ার কথা ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার মাত্রা তিন মাসের জন্য তাঁর চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করেছিল, এটাও ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। তা ছাড়া কেন্দ্র তাঁকে ডাকার কারণ দেখায়নি।’’
এদিকে, কেন্দ্র থেকে ফের চিঠি দিয়ে আলাপনকে ১ জুন দিল্লিতে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। মমতা সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ওই চিঠি আসার আগেই যেহেতু আলাপন অবসর নিয়েছেন, তাই ওই চিঠি গুরুত্বহীন।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে যোগ না দিয়ে মুখ্যসচিব জাতীয় বিপর্যয় মোকাবেলা আইন ভঙ্গ করেছেন অভিযোগ করে ১ জুন ফের আলাপনকে কারণ দর্শানোর চিঠি পাঠিয়ে তিন দিনের মধ্যে উত্তর দিতে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
‘‘আলাপন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার কর্মজীবনে এমন পরিস্থিতি এলে আমি একই কাজ করতাম,” বেনারকে বলেন রাজ্যের এক প্রাক্তন মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়।
“বিমানবন্দরে ফুলের তোড়া হাতে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়ে না থাকার জন্য কোনো মুখ্যসচিবকে শাস্তি দেওয়া যায় না, এটা বোঝা উচিত," বেনারকে বলেন ভারত সরকারের সাবেক শীর্ষ আমলা জহর সরকার।
কেন্দ্রের আচরণকে দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাত হিসেবে বর্ণনা করে মমতা দেশের সমস্ত বিরোধী দলগুলোকে কেন্দ্রের ‘প্রতিহিংসার রাজনীতির’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আবেদন জানিয়েছেন।
রাজ্যের নির্বাচনে হার হজম করতে না পেরেই মোদি সরকার এমন আচরণ করছে বলে দাবি তৃণমূলের এই শীর্ষ নেতার।
ভোট-পরবর্তী হিংসা
গত ২ মে রাজ্যের নির্বাচনে দুই–তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস, ক্ষমতায় আসার পরই শাসক দলের বিরুদ্ধে হিংসার অভিযোগে সরব হয় বিজেপি।
দলের রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অভিযোগ তোলে, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপি কর্মীদের ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে, ঘরছাড়া করে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের। এই হিংসার প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানও বয়কট করে বিজেপি।
হিংসার নিন্দা করে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় রাজ্য সরকারের পরামর্শ উপেক্ষা করেই কোচবিহার এবং পূর্ব মেদিনীপুরে যান কিছু এলাকা পরিদর্শনে।
কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে তড়িঘড়ি একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠানো হয় পশ্চিমবঙ্গে, রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ভোট-পরবর্তী হিংসার খতিয়ান তৈরির উদ্দেশ্যে। রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রেখে এভাবে কেন্দ্রীয় দল পাঠানোর তীব্র প্রতিবাদ জানান মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং।
কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে অবনতির আরও একটি দৃষ্টান্ত করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের বাড়বাড়ন্তের মধ্যেই ২০১৪ সালের নারদ-মামলায় অভিযুক্ত চার উল্লেখযোগ্য নেতাকে ১৭ মে সিবিআই-এর আচমকা গ্রেপ্তার। তাঁরা হলেন; কলকাতার সাবেক মেয়র ও পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, বিধায়ক মদন মিত্র এবং তৃণমূলের সাবেক শীর্ষনেতা শোভন চট্টোপাধ্যায়, যিনি দল বদলে বিজেপি-তে যোগদান করলেও বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলত্যাগ করেন।
তাঁদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে কলকাতার বেশ কিছু এলাকা। হাইকোর্টের নির্দেশে তাঁদের জেল হেফাজতে পাঠানো হলেও পরে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন ওই চার নেতা।