সংঘর্ষ নয়, যশোরে সাজাপ্রাপ্ত তিন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ

পুলক ঘটক
2020.08.14
ঢাকা
200814_Killing_three_teenage_1000.jpg আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাবার জন্য যশোরের সরকারি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রবেশ করছে একটি অ্যাম্বুলেন্স। ১৩ আগস্ট ২০২০।
[বেনারনিউজ]

দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা যশোরের সরকারি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনা নতুন মোড় নিয়েছে। কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ প্রথমে বলেছিল, দুই দল কিশোরের মধ্যে সংঘর্ষে তিনজন মারা গেছে। তবে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত কিশোরেরা অভিযোগ করেছে, সংঘর্ষ নয়, কেন্দ্রের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।

শুক্রবার পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) একেএম নাহিদুল ইসলাম শিশুকেন্দ্র পরিদর্শনের পর বন্দি কিশোরদের দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির তথ্য নাকচ করে সাংবাদিকদের বলেন, “আসলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। ঘটনাটি একপক্ষীয়।”

“শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ১০ জন কর্মকর্তাকে শুক্রবার ‍পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে,” বেনারকে জানান যশোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আশরাফ। বন্দি কিশোরদের পিটিয়ে মারার অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, “মূলত এ কারণেই তাঁদের থানা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।”

পুলিশ জানায়, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহ-তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিকুর রহমান, শারীরিক প্রশিক্ষক শাহনূর রহমানসহ ১০জন তাদের হেফাজতে আছেন।

পুলিশ সুপার বলেন, “এখন পর্যন্ত তাঁদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আশা করছি খুব শিগগির মূল অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।”

বৃহস্পতিবার শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে তিন কিশোর নিহত হয়, আহত হয় ১৪ জন। নিহতরা হলো; বগুড়ার শিবগঞ্জের তালিবপুর পূর্ব পাড়ার নান্নু পরমানিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭), একই জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) এবং খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮)।

শুক্রবার সন্ধ্যার পর মামলা দায়ের করেছেন নিহত রাব্বির বাবা রোকা মিয়া। মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে কারও নাম উল্লেখ না করে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে বিবাদী করা হয়েছে।

নিহত রাব্বির চাচা সেলিম মিয়া বেনারকে বলেন, “ভাতিজার লাশ নিয়ে খুলনায় যাচ্ছি।”

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স থেকে কান্না আর আহাজারি শোনা যাচ্ছিল।

“পুলিশই মামলা লেখাইছে। মামলায় আসামিদের কারও নাম দেওয়া হয়নি,” বলেন সেলিম মিয়া। তিনি আরো বলেন, “কেন্দ্রের ভেতরে কোনও মারামারি হয়নি। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের স্যারেরা ছেলেদের পিটায়ে মারছে। আমরা বিচার চাই।”

পুলিশ সুপার বলেন, “এখন যারা আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তারাই এই ঘটনার মূল সাক্ষী। মৃত্যুপথযাত্রী কেউ মিথ্যা কথা বলে না। তাদের কথার সত্যতা ও যৌক্তিকতা রয়েছে। আমাদের অনুসন্ধানে তাদের বক্তব্য গুরুত্ব পাবে।”

বিভিন্ন মামলায় ১৮ বছরের নিচের সাজাপ্রাপ্ত কিশোরদের জন্য দেশে দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। এর একটি গাজীপুরের টঙ্গিতে, অন্যটি যশোরের শহরতলী পুলেরহাটে। যশোরের ওই কেন্দ্রে বন্দির সংখ্যা ২৮০জন। কেন্দ্রটি সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন। ঘটনার পর শুক্রবার বন্দিদের স্বজনরা কেন্দ্রটির সামনে উদ্বেগ–উৎকন্ঠা নিয়ে ভিড় করেন।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের যশোরের উপপরিচালক অসিত কুমার সাহার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

গত ৩ আগস্টের একটি তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে বৃহস্পতিবার শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বন্দিদের মারধর করা হয় বলে জানিয়েছে যশোর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত বালকেরা। আহতদের সঙ্গে কথা বলে বেনারকে এ খবর নিশ্চিত করেছেন যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি প্রণব দাস।

“গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রের হেড গার্ড (আনসার সদস্য) নূর ইসলাম আমাকে তাঁর চুল কেটে দিতে বলেন। সেদিন কেন্দ্রের অনেকের চুল কেটে দিতে হয়েছিল আমাকে। এতে আমার হাত ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। সেজন্য আর চুল কাটতে পারিনি,” হাসপাতালে প্রণব দাসকে জানান ওই কেন্দ্রের আহত বন্দি চুয়াডাঙ্গার মো. পাভেল।

পাভেল জানায়, “এ জন্য নূর স্যর আমাকে বকাঝকা করেন। এতে আমার সঙ্গীরা ক্ষিপ্ত হয় এবং নূর স্যারকে মার দেয়। এরপর বিষয়টি তিনি কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন।”

ওই দিনের ঘটনার বিষয়ে জানতে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে বন্দি কিশোরদের কেন্দ্রের অফিসে ডেকে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের নামে কিশোরদের পেটানো হয় বলে জানায় পাভেল।

“স্যারেরা নিজেরা মেরেছিল এবং আমাদের মারার জন্য আরও কয়েকজন বন্দিকে দায়িত্ব দিয়েছিল,” প্রণব দাসকে জানায় ওই কেন্দ্রের আরেক আহত বালক নোয়াখালীর জাবেদ হোসেন।

“আমাদের লোহার পাইপ দিয়ে মেরেছে। জানালার গ্রিলের ভেতর আমাদের হাত ঢুকিয়ে বেঁধে মুখের ভেতর কাপড় দিয়ে এবং পা বেঁধে বেদম মারধর করা হয়েছে। অচেতন হয়ে গেলে আমাদের কাউকে রুমের ভেতর আবার কাউকে বাইরে গাছতলায় ফেলে রাখা হয়,” জানায় জাবেদ।

যশোরের বসুন্দিয়া এলাকার বন্দি ঈষান স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়ছে, “রাসেল আর আমি একই রুমে থাকতাম। আগামী মাসেই তার জামিনে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। স্যারদের বেদম মারপিটের পর চিকিৎসা না পেয়ে সে মারা গেছে।”

নিহত রাসেলের মা সুবেদা বিবি বেনারকে বলেছেন, “আমার ছেলের জামিন হয়ে গেছে, ওর বের হওয়ার কথা। ওকে এরা কেন মেরে ফেলল, এর বিচার চাই।”

তবে প্রবেশন অফিসার মুশফিক আহমেদ কেন্দ্রের ভিতরে কিশোরদের পিটিয়ে মারার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

থানায় অবস্থানের সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “সম্প্রতি কেন্দ্রে বন্দি কিশোরদের দুই গ্রুপের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এরই জের ধরে বৃহস্পতিবার বিকেলে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে হতাহতের ঘটনা ঘটে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।