ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন: যশোরে তিন কিশোর বন্দির মৃত্যুর কারণ মাথায় আঘাত

পুলক ঘটক
2020.08.18
ঢাকা
200818_Jessore_Juvenile_1000.jpg যশোর সদরের পুলেরহাটে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের সামনে বন্দিদের কয়েকজন দর্শনার্থী। ১৪ আগস্ট ২০২০।
[বেনারনিউজ]

মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণেই যশোরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তিন কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে ময়নাতদন্তে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি সোমবার রাতে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে পুলিশ সুপারের কাছে পাঠানো হয়েছে।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. দিলিপ কুমার রায় মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “নিহতদের অতিমাত্রায় নির্যাতন করা হয়েছিল। তিনজনেরই পায়ে, পিঠে ও মাথায় আঘাতের সুস্পষ্ট চিহ্ন পেয়েছি। তবে তারা ‘হেড ইনজুরির’ (মাথায় আঘাতের) কারণেই মারা গেছে।”

পিটুনিতে মারা যাওয়া ওই তিনজনের শরীরে একই ধরনের আঘাত করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন যশোর জেনারেল হাসপাতালের এই তত্ত্বাবধায়ক।

জেলার সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন বেনারকে বলেন, “হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনটি আমার কাছে পাঠানো হয়েছিল। আমি নিয়মমাফিক সেটি আজ যশোরের পুলিশ সুপারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।”

এদিকে যশোর জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক অসিত কুমার সাহা অভিযোগ করেছেন, আট পুলিশ এবং ১৫ আনসার সদস্যের উপস্থিতিতেই কেন্দ্রে ওই তিন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

“তারাই সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। কেন্দ্রের ভেতরে নিরাপত্তার সার্বিক দায়িত্ব সব সময়ই আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের উপর অর্পিত থাকে,” মঙ্গলবার বেনারকে বলেন অসিত।

একই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ১৫ বন্দি। তবে এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কারো বিরুদ্ধে কোনো প্রকার ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যশোরের চাঁচড়া ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত পরিদর্শক মো. রোকিবুজ্জামান বেনারকে জানান, তিনি শুধু হত্যাকাণ্ডের অভিযোগটি তদন্ত করছেন।

“পুলিশ ও আনসার সদস্যদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দেখবেন,” বলেন রোকিবুজ্জামান।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারো বিরুদ্ধে হত্যা বা নির্যাতনে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সাক্ষীদের ভাষ্য অনুযায়ী পুলিশ ও আনসার সদস্যরা সেখানেই ছিল। তবে হত্যায় তাঁদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ সরাসরি কেউ করেনি।”

কেন্দ্রের হেডগার্ড নুরুল ইসলামের অভিযোগের ভিত্তিতেই ওই ১৮ কিশোরকে বেঁধে পেটানো হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি।

“তিনি উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু কাউকে মেরেছেন বলে অভিযোগ পাইনি,” বলেন রোকিবুজ্জামান।

এখন পর্যন্ত শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের পাঁচ কর্মকর্তা এবং সাত জন বন্দি কিশোরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

“বন্দি আট কিশোরকে গ্রেপ্তারের জন্য আদালতে আবেদন দিয়েছিলাম। আদালত সাত জনের ব্যপারে অনুমতি দিয়েছে। আরেকজনের ব্যাপারে বুধবার শুনানি হবে,” বলেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এর আগে রোববার আহত শিশু কেন্দ্রের কর্মচারী ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যদের সঙ্গে আলাপের পর সমাজসেবা অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির প্রধান ও অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সৈয়দ মো. নুরুল বাসিরও সাংবাদিকদের বলেন, “কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যরা চাইলে ঠেকানো যেত এই নির্যাতনের ঘটনাটি।”

এ বিষয়ে জানতে যশোরের পুলিশ সুপার আশরাফ হোসেনের মুঠোফোনে বারবার কল করা হলেও মঙ্গলবার দিনভর তাঁর সাড়া মেলেনি। বেনার প্রতিনিধির পাঠানো বার্তারও কোনো জবাব দেননি তিনি।

তবে শুক্রবার বিবিসিকে এসপি জানান, হত্যার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করছেন তাঁরা।

উন্নয়ন, নাকি নির্যাতন কেন্দ্র?

গত ১৩ আগস্টের এই বিভৎস ঘটনার আগেও অনেক শিশুর অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে যশোরের সদর উপজেলার পুলেরহাট এলাকায় ওই শিশু সংশোধানাগারে। ২০১১ সাল থেকে এই সর্বশেষ ঘটনার আগ পর্যন্ত অন্তত চার শিশু নিহত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

২০১১ সালের ২৯ আগস্ট আকাশ নামের ১২ বছরের এক শিশুর গলাকাটা লাশ পাওয়া গিয়েছিল শিশু কেন্দ্রে।

২০১৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহীর তানোর থানার কিশোর গোবিন্দ শিশু কেন্দ্রে আসার আট দিনের মাথায় ২২ জুন দিনের বেলা সিঁড়ির গ্রিলের সঙ্গে গামছায় ঝোলানো অবস্থায় তাঁর লাশ পাওয়া যায়।

তিন মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষের বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে গলায় গামছা দিয়ে ঝুলতে দেখা যায় ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার কাঞ্চনপুর গ্রামের মাসুদ হোসেন নামের ১৪ বছরের এক কিশোরকে।

২০১৯ সালের মে মাসে নূরুল ইসলাম নামের আরেক শিশুর লাশ ঘরের ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল।

প্রত্যেকটি ঘটনাই আত্মহত্যা বলে দাবি করেছেন শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা।

এসব ঘটনার উপর গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও শিশু অধিকার কর্মী গওহার নঈম ওয়ারা। বেনারের সাথে আলাপকালে ওই ঘটনাগুলো বর্ণনা করে তিনি প্রশ্ন তোলেন, “এগুলো কি আদৌ আত্মহত্যা?”

“একটি সুরক্ষিত শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে এত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে কীভাবে? এই প্রত্যেকটি ঘটনা আসলে হত্যাকাণ্ড ছিল কিনা সে বিষয়ে নিবিড়ভাবে তদন্ত করা দরকার। এক্ষেত্রে বিচারবিভাগীয় তদন্ত হলে ভালো হয়,” বলেন তিনি।

তাঁর দাবি, “এসব কেন্দ্রকে শিশু নির্যাতন কেন্দ্র বললেই সঠিক বলা হয়। নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বড়জোড় বদলি করা হয়। কিন্তু কেন্দ্রে নির্যাতন বন্ধ হয় না।”

সাময়িক বরখাস্ত পাঁচজন

শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের আরও চার কর্মকর্তাকে সোমবার রাতে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা হচ্ছেন- শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের উপ-তত্ত্বাবধায়ক (প্রবেশন অফিসার) মাসুম বিল্লাহ, কারিগরি প্রশিক্ষক (ওয়েল্ডিং) ওমর ফারুক, ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর একেএম শাহানুর আলম ও সাইকো সোশ্যাল কাউন্সেলর মুশফিকুর রহমান।

এর আগে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) আব্দুল্লাহ আল মাসুদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। এ নিয়ে অভিযুক্ত পাঁচ কর্মকর্তাকেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।