শোবার ঘরে গলা কেটে চার বৌদ্ধকে হত্যা
2019.09.26
কক্সবাজার ও ঢাকা

কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় সংখ্যালঘু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এক পরিবারের চার সদস্যকে জবাই করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহতদের মধ্যে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারী ও দুই শিশু রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
ঘটনাটি উখিয়ার রত্নাপালং ইউনিয়নের পূর্বরত্নাপালং গ্রামে ঘটেছে বলে বেনারকে জানান কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন।
নিহতরা হলেন, কুয়েত প্রবাসী রুখেন বড়ুয়ার মা সখি বড়ুয়া (৬০), রুখেনের স্ত্রী মিলা বড়ুয়া (২৪), তাঁর ছেলে রবিন বড়ুয়া (৫) ও তাঁর বড় ভাই নিপু বড়ুয়ার মেয়ে সনি বড়ুয়া (৬)।
নিহত মিলা বড়ুয়া চার মাসের গর্ভবতী ছিলেন বলে পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে জানান পুলিশ সুপার মাসুদ হোসেন।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে এই ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
হত্যার কারণ নিশ্চিত নয়
কক্সবাজার জেলায় সংখ্যালঘু বৌদ্ধদের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। পুলিশ ও স্থানীয় বৌদ্ধরা বলছেন, এভাবে বৌদ্ধদের হত্যার ঘটনা এটাই প্রথম।
পুলিশ বলছে, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ধর্মীয় কারণে ঘটেছে কি না সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক এবং মর্মান্তিক বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ। এখানে সকল ধর্মের মানুষ শান্তিতে বসবাস করে। এখানে ধর্মীয় কারণে কারও প্রাণ যায় না।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “পুলিশ ঘটনা তদন্ত করছে। যারাই ঘটিয়ে থাকুক না কেন দোষীদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।”
কক্সবাজার বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে বৌদ্ধদের ঘরে ঢুকে একই পরিবারের এতগুলো মানুষকে হত্যার ঘটনা আগে আর ঘটেনি।”
“ঘটনাটি খুবই বেদনাদায়ক এবং মর্মান্তিক। এ ধরনে ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না,” বলেন তিনি।
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, “আমরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীসহ সকল মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের নিশ্চয়তা চাই।”
তিনি বলেন, “ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক না কেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের কাছে জড়িতদের চিহ্নিত করার দাবি জানাই।”
ধর্ষণের পরে হত্যা
সিআইডির পরিদর্শক এ এম ফারুক বেনারকে বলেন, “ঘটনাস্থল একটি ধারালো দা ও একটি ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মিলা বড়ুয়াকে হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ধরনের কিছু আলামত পাওয়া গেছে।
“ধারণা করা হচ্ছে, ধর্ষণের পরে তাঁকে জবাই করে হত্যা করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে এ বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে,” বলেন তিনি।
এ এম ফারুক বলেন, “হত্যার ধরন দেখে মনে হচ্ছে বুধবার মধ্যরাতের পর তাঁদের হত্যা করা হয়েছে।”
যেভাবে জানা গেল
স্থানীয় বাসিন্দা পলাশ বড়ুয়া বেনারকে জানান, মৃত প্রবীণ বড়ুয়ার চার ছেলের মধ্যে কুয়েত প্রবাসী রুখেন বড়ুয়া সবার ছোট।
অন্য তিন ভাই রবিসন বড়ুয়া, দীপু বড়ুয়া ও সিপু বড়ুয়া আলাদা ঘরে বসবাস করেন। আর তাঁদের মা সখি বড়ুয়া ছোট ছেলের সঙ্গে থাকতেন।
পলাশ আরও বলেন, “বৃহস্পতিবার সকাল সাতটার দিকে ওই বাড়ির ফ্রিজে রাখা মাছ আনতে যান দ্বীপালী বড়ুয়া নামের এক প্রতিবেশী। কিন্তু সকাল হওয়ার পরেও ওই বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।”
তিনি বলছিলেন, “লোকজনের কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে তাঁর সন্দেহ হয়। পরে তিনি পাশের বাড়িতে সিপু বড়ুয়ার বউকে বিষয়টি জানান কিন্তু সিপুর বউ কোনো সাড়া না দেওয়ায় তিনি বড় ছেলে রবিসন বড়ুয়াকে ডাকেন।”
“পরে তাঁরা জানালা দিয়ে সখি বড়ুয়ার রক্তাক্ত মরদেহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেন। এর পর ঘটনার জানাজানি হয় এবং পরে বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়,” বলেন পলাশ।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, পুলিশ সুপার মো. এবিএম মাসুদ হোসেন, উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরী, উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) নুরুল ইসলাম মজুমদার।
এ ছাড়া র্যাব, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয়।
পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, “বাড়িটি ছাদ দেওয়া পাকা বিল্ডিং। বাইরে থেকে লোহার গ্রিলে তালা লাগানো এবং দরজা বন্ধ অবস্থায় ছিল। এ অবস্থায় ঘরের ভেতরে একটি কক্ষে শাশুড়ি, অন্য কক্ষে বউ এবং আরেকটি কক্ষ দুই শিশুর মরদেহ পাওয়া গেছে।”
“তাই ধারণা করা হচ্ছে, ছাদের ওপরের সিঁড়ি বেয়ে দুর্বৃত্তরা ভেতরে প্রবেশ করে এ ঘটনা ঘটিয়েছে,” বলেন তিনি।
ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত এবং ঘটনার সঙ্গে ওই পরিবারের সঙ্গে আগে থেকেই জানাশোনা আছে এ রকম লোকজন জড়িত থাকতে পারে ধারণা করছেন মাসুদ হোসেন।