বাগেরহাটের পর এবার ঢাকায় পুলিশ হেফাজতে যুবকের মৃত্যু
2020.09.30
ঢাকা

পুলিশের হেফাজতে এবার রাজধানী ঢাকার পল্টন থানায় মাসুদ রানা (৩৩) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহতের স্বজনদের দাবি, মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের কাচপুর এলাকা থেকে ধরে আনার পর মাঝরাতে তাঁর মৃত্যুর খবর জানিয়েছে পুলিশ।
“পুলিশের নির্যাতনেই মাসুদের মৃত্যু হয়েছে” বুধবার অভিযোগ করেছেন তাঁর শ্বশুর আবদুল মান্নান ও স্ত্রী রেহানা বেগম।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের (ডিএমপির) মুখপাত্র ওয়ালিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ। মাসুদ ও তাঁর বন্ধু মমিনকে (৩৬) গুলিস্তান এলাকা থেকে তিনশ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।”
“সে (মাসুদ) মাদক ব্যবসায়ী ছিল এবং সেবনও করত। থানায় আনার কিছুক্ষণ পর রাত সাড়ে নয়টার দিকে মাদকের প্রভাবে সে অস্থির আচরণ করতে শুরু করে। উত্তেজিত হয়ে হঠাৎ করেই লুটিয়ে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পায়,” বলেন ডিএমপির এই উপ-কমিশনার (ডিসি)।
“পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন,” যোগ করেন তিনি।
মাসুদ রানার বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মাদক আইনে একটি মামলা রয়েছে বলেও জানান ডিএমপির এই মুখপাত্র।
তবে মাসুদ মাদকসেবী বা বিক্রেতা ছিলেন না দাবি করে তাঁর স্ত্রী রেহানা বেগম বলেন, তিনি স্ত্রী এবং ১২ বছর ও ১৯ মাস বয়সী দুই কন্যা নিয়ে কাচপুর এলাকায় থাকতেন। ঢাকার যাত্রাবাড়িতে ফয়সাল রোলিং মিল নামের একটি ‘ওয়েল্ডিং ফার্মে’ (ঝালাই কারখানা) লোহার প্লেট কাটার কাজ করতেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে রেহানা সাংবাদিকদের জানান, স্বামীর লাশের খোঁজে পল্টন থানায় যাওয়ার পর পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁকে একটি ভিডিও দেখিয়েছেন। “ভিডিওতে অসুস্থ মাসুদকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, পুলিশ তাঁকে অনেক মারধর, নির্যাতন করেছে,” বলেন তিনি।
রেহানা এ ঘটনার বিচার দাবি করলেও তাঁর বাবা আবদুল মান্নান বেনারকে বলেন, “পুলিশের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সামর্থ্য বা সাহস আমাদের নেই।”
রেহানা তাঁর একমাত্র সন্তান জানিয়ে তিনি বলেন, “সুখের সংসার ছিল মেয়েটার। সব তছনছ হয়ে গেলো।”
“মাসুদকে মঙ্গলবার দুপুরে কাচপুরের সিনহা টেক্সটাইলের সামনে থেকে আটক করে পুলিশ। পরে আমরা জানতে পারি, তাঁকে ধরে পল্টন থানায় নেওয়া হয়েছে,” বলেন মান্নান।
পুলিশ মঙ্গলবার রাতেই ফোন করে মাসুদের মৃত্যুর সংবাদ দিয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
“মর্গ থেকে লাশ বুঝে নেওয়া হয়েছে, কাচপুরেই মরদেহ দাফন করা হবে,” বুধবার সন্ধ্যায় বেনারকে বলেন মান্নান।
যেভাবে খবর পায় পরিবার
“আমার সঙ্গে এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল ফোনে কথা হয়। স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা সে সুযোগ আমাকে দেয়নি। রাত এগারোটার দিকে খবর পাই সে অসুস্থ, তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে,” বলেন রেহানা।
এর কিছুক্ষণ পরেই তাঁকে জানানো হয়, মাসুদের মৃত্যু হয়েছে।
ঢামেক হাসপাতালে নেওয়ার আগে মাসুদকে রাজারবাগের পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল বলেও জানিয়েছেন ডিএমপির কর্মকর্তারা। ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া সাংবাদিকদের জানান, পল্টন থানার এসআই এনামুল হক লাশটি রেখে গিয়েছেন।
এর আগে মঙ্গলবার বাগেরহাট সদর উপজেলার খানজাহান আলী দীঘির পাড় এলাকার রাজা ফকির (২২) জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) নির্যাতনে মারা গেছেন বলে অভিযোগ করে তাঁর পরিবার।
রবিবার পটুয়াখালী থেকে আটক হওয়া হত্যা মামলার আসামি রাজাকে সোমবার দুপুরে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল পিবিআই সদস্যরা।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব মতে, দেশে সামরিক, আধা-সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর নির্যাতনে ২০০৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২৩৮ জনই মারা গেছেন র্যাব-পুলিশ ও গোয়েন্দাদের হাতে।
আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর নির্যাতন ও পিটুনিতে চলতি বছরে প্রথম ছয় মাসেও ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
মানবাধিকার কর্মীর উদ্বেগ
পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাগুলো কালেভদ্রে বিচারের আওতায় আসে উল্লেখ করে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “মূলত বিচার কম হওয়ার কারণেই এ ধরনের অপরাধ থামছে না। ১০-১৫ বছর পর একটি ঘটনার বিচার হচ্ছে।”
মানবাধিকার কর্মীদের হিসেবে, এ পর্যন্ত নিরাপদ হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা দায়ের হয়েছে। ২০১৩ সালে ওই আইন পাস হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর নিম্ন আদালতে এমন একটি মামলার প্রথম রায় হয়েছে।
রায়ে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইশতিয়াক হোসেন জনি নামের এক গাড়িচালককে থানায় নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে পল্লবী থানার তৎকালীন পুলিশের তিন কর্মকর্তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে আদালত। অন্য দুই আসামিকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
“ওই রায়ের পর এ মাসেই আবারও এমন দুটি ঘটনা ঘটায় বোঝাই যাচ্ছে পরিস্থিতি কতটা নাজুক,” বলেন নূর খান।
তিনি মনে করেন, বর্তমানে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তাঁদের অতিমাত্রায় নির্ভরতাই পুলিশকে অসহিষ্ণু করে তুলছে। সরকার এমন কোনো বার্তা দিতে পারছে না, যাতে তারা আইনের মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হয়।
“পুলিশের ‘চেইন অব কমান্ডে’ বেশ কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি বা দুর্বলতা রয়েছে, যেগুলো ঠিক না করে তাদের আইন মেনে কাজ করানো অসম্ভব। তা ছাড়া পুলিশে সব নিয়োগ, বদলি বা পদোন্নতি এখন শুধু রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই হচ্ছে,” যোগ করেন নূর খান।