সিলেটে পুলিশ হেফাজতে যুবকের মৃত্যু: এসআই আকবরের দেশত্যাগে সতর্কবার্তা

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.10.16
ঢাকা
201016_Muder_Police_Custody_1000.JPG সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে ‘রং-তুলিতে দুষ্কাল’ শিরোনামে এক কর্মসূচিতে সাম্প্রতিক সময়ে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে নারী ধর্ষণ ও পুলিশ ফাঁড়িতে পিটিয়ে যুবক হত্যাসহ বিভিন্ন নিপীড়ন ও নির্যাতনের ছবি এঁকে প্রতিবাদ জানান চিত্রশিল্পীরা। ১৬ অক্টোবর ২০২০।
[নিউজরুম ফটো]

সিলেটে পুলিশ হেফাজতে নিহত যুবক রায়হান আহমেদ (৩৩) হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে ধরতে দেশের সকল বিমান, স্থল ও সমুদ্রবন্দরে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

রোববার সিলেট মহানগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিহত হওয়ার দুদিন পর মঙ্গলবার থেকে পলাতক রয়েছেন আকবর। তাঁর দেশত্যাগ ঠেকাতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান।

রায়হান হত্যাকাণ্ড তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে যাওয়ার পর থেকে আকবরকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে বেনারকে জানিয়েছেন ব্যুরোর ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।

তিনি বলেন, “এই খুনের জন্য কে দায়ী তা বের করতে প্রথমেই এসআই আকবরকে দরকার। সে মঙ্গলবার সকাল থেকে পলাতক। সে যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে, সেজন্য আমরা সকল বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও সমুদ্রবন্দরে অ্যালার্ট জারি করেছি।”

বনজ মজুমদার বলেন, “রায়হানের লাশ কবর থেকে তুলে তদন্ত করছে পিবিআই।”

যা ঘটেছিল

সিলেটের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রাতে কাজ করতেন রায়হান আহমেদ। সাধারণত তাঁর বাসায় ফিরতে রাত ১২টা থেকে একটা হয়ে যেত। শনিবার রাত ১০টায় বাসা থেকে বের হয়ে রায়হান ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যান।

রায়হানের মামাতো ভাই আব্দুর রহমান বেনারকে বলেন, সেদিন রাতে বাসায় ফেরেননি রায়হান।

ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ছিনতাইয়ের অভিযোগে তাঁকে ধরে নিয়ে যান বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আকবর ভূঁইয়াসহ কয়েকজন পুলিশ।

আব্দুর রহমান জানান, “ভোর চারটার দিকে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে তাঁর অভিভাবক রফিকুল ইসলামকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আসতে বলেন রায়হান।”

তাঁর ফোন পেয়ে কিছু টাকা নিয়ে বন্দরবাজার এলাকায় যান তিনি। কিন্তু সেখানে এক পুলিশ সদস্য ছিলেন। অন্য কেউ ছিলেন না।

রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ওই পুলিশ সদস্য তাঁকে বলেছিলেন, যাঁরা রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছেন তাঁরা সবাই ঘুমিয়ে গেছেন। সে সময় রায়হানের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও দেখা করতে দেওয়া হয়নি। ওই পুলিশ তাঁকে বলেন, তিনি যেন সকাল সাড়ে ৯টা-১০টার দিকে ফাঁড়িতে আসেন।

রায়হানের মামাতো ভাই আবদুর রহমান জানান, সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে যাওয়ার পর জানানো হয়, রায়হান ফাঁড়িতে নেই; হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

এরপর তাঁরা সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন রায়হান মারা গেছেন। তাঁর লাশ হিমাগারে রাখা ছিল।

রায়হানের মৃত্যুর খবর জানাজানি হলে পুলিশ সাংবাদিকদের জানায়, মহানগরীর কাষ্টঘর এলাকায় ছিনতাই করার সময় গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে রায়হানের।

তবে কাষ্টঘর এলাকার কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মোনিম সাংবাদিকদের বলেন, শনিবার রাত ১২টা থেকে রোববার সকাল ৭টা পর্যন্ত কাষ্টঘর এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে দেখা গেছে ওই এলাকায় গণপিটুনির কোনো ঘটনা ঘটেনি।

তিনি বলেন, এমনকি এই দিন ওই সময়ে কাষ্টঘর এলাকায় পুলিশের কোনো টহলও ছিল না।

এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠেন এলাকার জনগণ। রায়হান হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে তাঁরা সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করেন।

পুলিশি হেফাজতে রায়হানের মৃত্যুর দায়ে এসআই আকবরসহ কয়েক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা।

এসআই আকবরসহ চার পুলিশ সদস্যকে বরখাস্ত করে সরকার।

‘পুলিশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে জনগণ

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, পুলিশের হাতে অসংখ্যক নিরাপরাধ মানুষ প্রতিদিন নির্যাতিত হচ্ছেন। কিছু আমরা জানতে পারছি। যখন কেউ মারা যায় তখনই বিষয়টি জানা যায়। আবার অনেক ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে না। মানুষ প্রকাশ করতে ভয় পায়।

তিনি বলেন, “মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মানুষ সাহস পায় যে, পুলিশে হাতে নির্যাতিত হলে মামলা করা যায়।”

ড. মিজানুর রহমান বলেন, “গত মাসে পল্লবী থানা হেফাজতে নিহত যুবক জনি হত্যাকাণ্ডের বিচারে তিন পুলিশের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়ার পর জনগণ সাহসী হয়ে উঠছে।”

উল্লেখ্য, গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি বিচারিক আদালত ২০১৪ সালে পল্লবী থানায় জনি নামের এক গাড়িচালককে হত্যার দায়ে এসআই জাহিদ, এসআই কামরুজ্জামান এবং এসআই রাশিদুল হককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।

মিজানুর রহমান বলেন, “জনগণকে কথা বলতে হবে। সহ্য করলে এ ধরনের  মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনা বৃদ্ধি পাবে।”

পুলিশি হেফাজতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হলে ২০১৩ সালে পাস হওয়া নিরাপদ হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনের আওতায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদদ্যদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান রয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে গত দুই সপ্তাহে সিলেট, ঢাকার পল্টন ও নবাবগঞ্জ এবং রংপুরের গঙ্গাচড়ায় চারজন পুলিশের হেফাজতে মারা গেছেন।

সংস্থাটির মতে, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে এ বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৫৮ ব্যক্তি পুলিশ হেফাজতে প্রাণ হারিয়েছেন।

এক বিবৃতিতে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সাম্প্রতিক সকল মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।