নৌবাহিনী কর্মকর্তাকে মারধর: দেহরক্ষীসহ সাংসদপুত্রের এক বছরের জেল

জেসমিন পাপড়ি
2020.10.26
ঢাকা
201026_Irfan_Selim_arrested_1000.JPG পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাটে দেবদাস লেনে ইরফান সেলিমের বাসায় অভিযানকালে ওয়াকিটকি ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ বেশি কিছু অবৈধ জিনিস উদ্ধার করে র‌্যাব। ২৬ অক্টোবর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধরের জেরে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ও দক্ষিণ ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ইরফান সেলিম ও তাঁর দেহরক্ষীকে মদ পান ও অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার দায়ে সোমবার এক বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

সোমবার দুপুরে পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাটের দেবদাস লেনে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ হাজী সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ইরফান সেলিম (৩৭) ও তাঁর দেহরক্ষী জাহিদুল ইসলামকে (৩৫) গ্রেপ্তার করে র‍্যাব।

গ্রেপ্তারের পর মদ পানের জন্য ছয় মাস ও বাসায় অবৈধ ওয়াকিটকি রাখার দায়ে আরও ছয় মাসসহ ওই দুজনকে এক বছর করে কারাদণ্ড দেন র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম।

সন্ধ্যায় অভিযান শেষে সংবাদ সম্মেলনে সাজা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন র‌্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ।

তিনি জানান, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে এবং একজন ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত আসামি ইরফান সেলিমের বাসায় অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তাঁর বাসা থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, ইয়াবা, বিদেশি মদ, ১০ ক্যান বিয়ার, হ্যান্ডকাপ ও অনুমোদনহীন ৩৮টি ওয়াকিটকি উদ্ধার করা হয়েছে।

“এসব অস্ত্রের কোনো লাইসেন্স নেই। আর ওয়াকিটকিগুলোও অবৈধ। কালো রঙের এসব ওয়াকিটকি শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করতে পারেন,” যোগ করেন তিনি।

র‌্যাব কর্মকর্তা আশিক বিল্লাহ বলেন, “মদ্যপান ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করার অপরাধে ইরফান ও তাঁর দেহরক্ষীকে ছয় মাস করে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট।”

আপাতত তাঁদের কারাগারে নেওয়া হবে উল্লেখ করে তিনি জানান, এই দুজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে আরও দুটি নিয়মিত মামলা করা হবে।

এই নিয়ে এখন পর্যন্ত নৌবাহিনী কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সোমবার বলেন, “নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় যেই জড়িত থাকুক, তাঁকে আইনের আওতায় আনা হবে। সে জনপ্রতিনিধি হোক বা যেই হোক, তাঁকে আইনের মুখোমুখি হতেই হবে।”

এর আগে রোববার সন্ধ্যায় রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় মারধরের শিকার হন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেনেন্ট ওয়াসিফ আহম্মেদ খান। এ ঘটনায় ইরফান সেলিমসহ চারজনের নামে এবং দুই-তিনজনের নাম উল্লেখ না করে সোমবার সকালে ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করেন লেফটেনেন্ট ওয়াসিফ।

মামলার পরপরই আসামি আটক হওয়া প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সাধারণ মানুষ যেখানে জড়িত বা যাদের কোনো রকম শক্তিশালী সমর্থক নেই, তাঁদের বেলায় এমন হয় না। এমনকি তাঁরা মামলাও করতে পারে না।”

এটাই ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রতিফলন’ বলে মত দেন তিনি।

গত জুলাইতে কক্সবাজারে পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যার উদাহরণ টেনে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “টেকনাফের তদন্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ একটার পর একটা খুন করে যাচ্ছিল। কিন্তু সেটা বন্ধ হয়েছে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার মৃত্যুর পরে।”

“অর্থাৎ শক্ত প্রতিপক্ষ বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আগ্রহ থাকলেই সেসব ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়,” মনে করেন সুজন সম্পাদক।

উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

এ ঘটনায় টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাসসহ সাত পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। ওই মামলায় বরখাস্ত ওসি প্রদীপসহ বর্তমানে ১৪ জন আটক রয়েছেন, যাদের ১১জনই পুলিশ সদস্য।

মেজর সিনহা হত্যার ঘটনার পরে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারসহ জেলার ১ হাজার ৩৪৭ পুলিশকে বদলি করা হয়েছে।

গাড়িচালক রিমান্ডে

নৌবাহিনী কর্মকর্তা লেফটেনেন্ট ওয়াসিফের করা মামলায় ইরফান সেলিমসহ অন্যান্য অভিযুক্তরা হলেন; হাজী সেলিমের মদিনা গ্রুপের প্রটোকল অফিসার এবি সিদ্দিক দিপু (৪৫), ইরফানের দেহরক্ষী জাহিদ এবং গাড়িচালক মো. মিজানুর রহমান (৩০)।

আসামিদের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে পথরোধ করে সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর, জখম ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আনেন নৌবাহিনীর লেফটেনেন্ট মো. ওয়াসিফ আহমেদ খান।

এদের মধ্যে গাড়িচালক মিজানকে মামলার পরপরই আটক করা হয় বলে জানান ধানমন্ডি থানার ওসি ইকরাম আলী।

তিনি বেনারকে জানান, সোমবার আদালতে মিজানকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করলে একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।

মামলার এজহারে বলা হয়, গত ২৫ অক্টোবর রাত পৌনে ৮টার দিকে নীলক্ষেত থেকে বই কিনে লেফটেনেন্ট ওয়াসিফ ও তাঁর স্ত্রী মোটরসাইকেলে ঢাকা সেনানিবাসে ফিরছিলেন। কলাবাগান এলাকায় একটি গাড়ি তাঁদের পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। ওয়াসিফ ও তাঁর স্ত্রী ধাক্কা সামলে মোটরসাইকেল থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে এক ব্যক্তি তাঁদের গালিগালাজ করে ও হত্যার হুমকি দেয়। এসময় ওয়াসিফ নিজের পরিচয়ও দেন।

এরপর কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের কাছে সেই গাড়িটিকে থামিয়ে নৌ কর্মকর্তা আবারও পরিচয় দিলে গাড়ির আরোহীরা সবাই নেমে এসে তাঁকে কিলঘুষি মেরে রক্তাক্ত করে রাস্তায় ফেলে দেয়।

আহত নৌ কর্মকর্তা ওয়াসিফকে আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঘটনার সময় একজন পথচারীর মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।