চোখে কাপড় বেঁধে তুলে নেওয়া হয়: ইমরান এইচ সরকার
2018.06.07
ঢাকা

ক্রসফায়ার বিরোধী সমাবেশে থেকে তুলে নেওয়ার পর কালো কাপড়ে চোখমুখ বেঁধে ফেলা হয়। এরপর হাতকড়া পরিয়ে তাঁকে র্যাবের কার্যালয়ে নেওয়া হয় বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
“গাড়িতে ওঠানোর পর পরই আমাকে জমটুপির (ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে আসামিকে যে টুপি পরানো হয়) মতো একটি টুপি পরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় আমি কিছুই দেখছিলাম না, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল,” বলছিলেন ইমরান।
রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার এভাবে ঘটনার বর্ণনা দেন।
‘চলমান মাদকবিরোধী অভিযানের নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা’ বন্ধের দাবিতে গত বুধবার শাহবাগে পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ছিল গণজাগরণ মঞ্চের। মঞ্চের কর্মীরা যখন কেবল জড়ো হচ্ছিলেন তখন বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে সাদা পোশাকের র্যাব সদস্যরা ইমরানকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যান।
র্যাব ৩ কার্যালয়ে প্রায় ৭ ঘণ্টা অন্তরীণ রাখার পর বুধবার রাত সোয়া ১১টায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইমরান জানান, র্যাব কর্মকর্তারা তাঁকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁদের আন্দোলনের বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। এরপর ভাই-বোনকে ডেকে তাঁদের জিম্মায় তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ইমরান বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। একটা প্রতিবাদ সভা থেকে কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়া এভাবে সিনেমাটিক স্টাইলে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো কেবল প্রতিবাদ করার জন্য।”
তিনি আরো বলেন, “চোখমুখ ঢাকা থাকায় বুঝতে পারিনি কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটা স্থানে যাওয়ার পর আমার চোখমুখের কাপড় ও হাতকড়া খুলে দেওয়া হয়। কথাবার্তা শুনে মনে হলো র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসেছেন। জানালেন তাঁরা আলোচনা করতে চান।”
“তাঁরা জানতে চাইলেন, কিসের জন্য আন্দোলন করছেন? এর উদ্দেশ্য কী? কার বিরুদ্ধে আন্দোলন? এসব। এক পর্যায়ে র্যাব কর্মকর্তারা তাঁদের বক্তব্যে মাদকবিরোধী অভিযানের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। মাদকের বিরুদ্ধে যে অভিযান চলছে, তার যৌক্তিকতা তুলে ধরতে চান,” বলেন গণজাগরণ মঞ্চের এই মুখপাত্র।
ইমরান জানান, তিনি র্যাবের কর্মকর্তাদের বলেছেন, মাদকের বিরুদ্ধে যেমন তাঁরা সোচ্চার, তেমনই মাদকবিরোধী অভিযানের নামে যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে, তার বিরুদ্ধেও তাঁরা সোচ্চার। এ কথাটি তিনি তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা করেন।
তিনি বলেন, “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের একটি বড় অংশই হচ্ছে র্যাবের দ্বারা। আন্দোলনের বিষয়টিও তাঁদের বিরুদ্ধেই যায়। এ কারণে ক্ষোভের বশবর্তী হয়েই হয়তো তাঁরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।”
ইমরান বলেন, তাঁর সঙ্গে যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা হয়েছে সেটা নিয়ে শাহবাগেই কথা বলা যেত। তুলে নিয়ে একটা ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চালানো হচ্ছে যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনোভাবেই কাম্য নয়। এমনিতেই দেশে কথা বলার পরিবেশ নেই। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে মানুষ আরও চুপ হয়ে যাবে। এই ভীতিকর সংস্কৃতি কারো জন্যই মঙ্গলজনক বিষয় নয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে র্যাব ৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান বেনারকে বলেন, “ইমরানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁরা তথ্য নিয়েছেন। সেগুলো তদন্ত করে দেখা হবে।”
তবে কী বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এ নিয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।
চোখমুখ ঢেকে হাতকড়া পরিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ইমরানের বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করে তিনি বলেন, “স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।”
এদিকে অনুষ্ঠানের অনুমতি নেওয়া হয়নি র্যাবের এমন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলনে একটি আবেদনপত্রের কপি দেখানো হয়। ‘কর্মসূচি সম্পর্কে অবগতি ও নিরাপত্তার’ জন্য ৫ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার বরাবর ওই আবেদনপত্র দেওয়া হয়।
ইমরান জানান, শাহবাগ থানার পুলিশ এবং ঢাকা মহানগর পুলিশকে (ডিএমপি) লিখিতভাবে অবহিত করেই তাঁরা সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। তাই অনুমতি নেওয়া হয়নি বলে যে দাবি করা হয়েছে, তা সঠিক নয়।
তবে র্যাব জানায়, অনুমোদন ছাড়া কর্মসূচি পালন করতে যাওয়ায় ইমরানকে আটক করা হয়েছে।
গণজাগরণ মঞ্চ আয়োজিত গতকালের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যার প্রতিবাদে তাঁদের যে আন্দোলন চলছে সেটা অব্যাহত রাখার ঘোষণাও দেন ইমরান এইচ সরকার।
সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকারকর্মী খুশি কবীর বলেন, “মাদক বন্ধ করার নামে যে হারে গণহত্যা এবং মানুষকে ধরা হচ্ছে তা বেআইনি। কেউ দোষী হলে তাকে আইন আদালতের মাধ্যমে বিচারের পর দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তি দেওয়া হবে।”
শিক্ষাবিদ এ এন রাশেদা বলেন, “গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা নিরাপত্তার জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু তা না দিয়ে তাঁদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এটা পারে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে।”
কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত এক
এদিকে প্রতিবাদের মধ্যেও মাদকবিরোধী অভিযানে গত বুধবার দিবাগত রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মো. হেলিম মিয়া (৪০) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। তিনি তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী বলে জানান ভৈরব থানার ওসি মুখলেছুর রহমান।
পৌর শহরের পঞ্চবটীর এই বাসিন্দার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মাদকের ২০টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তবে পুলিশ তাঁর স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়েছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন হেলিমের স্ত্রী জুসনা বেগম।
মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে এ নিয়ে গত ২৪ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা দাঁড়াল ১৩৫ জন। এদের মধ্যে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৭২ ও র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৩৪ জন নিহত হয়েছেন। মাদক ব্যবসায়ীদের দু’পক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে বাকি ২৯ জন নিহত হয়েছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি।
অভিযান স্থগিতের আহ্বান এইচআরডব্লিউ’য়ের
চলমান ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধে’ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্ত করে দেখতে বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
বুধবার এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে মাদক গুরুতর সমস্যা। তবে এর বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযান আইনের শাসন মেনে ও অপ্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ ছাড়া করতে হবে।
সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিশ্চিত করতে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও প্রক্রিয়া অনুসরণ না করা পর্যন্ত সরকারের এই অভিযান স্থগিত রাখা উচিত।
এদিকে বাংলাদেশে মাদক বিরোধী অভিযান চলাকালে হত্যাকাণ্ড বন্ধে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ আহ্বান করেছে একটি মানবাধিকার গোষ্ঠী।
প্রায় দুই শত বেসরকারি সংস্থার ফোরাম ইন্টারন্যাশনাল ড্রাগ পলিসি কনসোর্টিয়াম বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানিয়েছে বলে জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে শরীফ খিয়াম।