ভেজাল মদ পান: অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু, ছয় বিক্রেতা আটক

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.02.02
ঢাকা
ভেজাল মদ পান: অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু, ছয় বিক্রেতা আটক বগুড়ায় মদ পানে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের একজনের মৃতদেহ শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে মর্গে নেওয়া হচ্ছে। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

বাংলাদেশে লাইসেন্স ছাড়া মদ্যপান নিষিদ্ধ হলেও ব্যাপক চাহিদা থাকায় ভেজাল মদ পান করে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক এরকম বেশ কিছু মৃত্যুর প্রেক্ষিতে ভেজাল মদ তৈরির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। 

পুলিশ জানায়, ভেজাল মদ পান করে গত শনিবার থেকে ঢাকা ও বগুড়ায় কমপক্ষে ১৪ ব্যক্তির মৃত্যুর পর এসব পণ্য তৈরি ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত অন্তত ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। 

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র ওয়ালিদ হোসেন বেনারকে বলেন, সোমবার রাত থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভেজাল মদ তৈরি সাথে সংশ্লিষ্ট ছয়জনকে আটক করা হয়েছে।

তাঁরা হলেন- মনতোষ চন্দ্র অধিকারী ওরফে আকাশ (৩৫), রেদুয়ান উল্লাহ (৩৫), সাগর বেপারী (২৭), নাসির আহমেদ ওরফে রুহুল (৪৮), মো. জাহাঙ্গীর আলম (৪৫) ও সৈয়দ আল আমিন (৩০)।

রাজধানীর তেজগাঁও ও ভাটারা থানা এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা। 

বগুড়ায় আটজনের মৃত্যু

ভেজাল মদ পান করে একদিনে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন বগুড়ায়। গত রোববার রাতে সেখানে ভেজাল মদ খেয়ে আটজন নিহত হন। তবে ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভুঁইয়া। 

আলী আশরাফ বেনারকে বলেন, হরিজন সম্প্রদায়ের মধ্যে মদ্যপান প্রথা চালু আছে। রোববার রাতে বগুড়া শহরের হরিজন সম্প্রদায়ের আবাসিক এলাকায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল।

ওই অনুষ্ঠানে মুসলমান কিছু মানুষও যোগ দিয়ে মদ্যপান করেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এরপর প্রায় সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে।”

“রোববার রাত থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত বিয়েতে অংশগ্রহণকারী মোট আটজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে পোস্টমর্টেম প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই আটজনের মধ্যে পাঁচজন মদ্যপান করার কারণে মারা গেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে,” বলেন আলী আশরাফ।

বাকিদের মৃত্যুর কারণ পোস্টমর্টেম প্রতিবেদন পাওয়ার পর নিশ্চিত করে বলা যাবে বলে জানান তিনি।

পুলিশ সুপার বলেন, “যেহেতু আমাদের দেশে মদ্যপান নিষিদ্ধ সেহেতু পরিবারের সদস্যরা আমাদের কিছু জানাচ্ছেন না; স্বীকার করতে চাচ্ছেন না তাঁরা মদ্যপান করে মৃত্যুবরণ করেছেন। বলছেন হঠাৎ মারা গেছেন।” 

তিনি বলেন, “আমরা প্রাথমিক তদন্তে যা জানতে পেরেছি, হরিজন সম্প্রদায়ের লোকদের কেনা মদের মধ্যে ইথানলের পরিবর্তে বিষাক্ত ও সস্তা মিথানল ব্যবহার করা হয়েছে। আর সে কারণেই এসব মৃত্যু।” 

নিহত এক ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “হোমিওপ্যাথিক ওষুধের যে দোকান থেকে মদ সংগ্রহ করা হয়েছিল, সেটির মালিক ও কর্মীরা পালিয়েছে। তাদের ধরতে অভিযান চলবে।”

পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে বেনারনিউজ নিহতদের পরিচয় প্রকাশ করছে না। 

গত কয়েকদিনে মদ্যপান করার পর অসুস্থ হয়ে ঢাকার ভাটারা থানা এলাকায় তিনজন, ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় একজন ও মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় দুইজনসহ মোট ছয় জনের মৃত্যু হয় বলে বেনারকে জানান ডিএমপির মুখপাত্র ওয়ালিদ হোসেন। 

মদ্যপানে অন্তরায় আইন ও ধর্ম

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে মদ্যপান আইনত নিষিদ্ধ। ইসলাম ধর্মও এটি সমর্থন করে না।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক একেএম শহিদুল হক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “যদি কোনো মুসলমান মদ খেতে চায় তাহলে তাকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হবে এবং এই লাইসেন্স নেয়ার জন্য একজন ডাক্তারের কাছ থেকে সুস্থতার সনদ নিতে হবে।”

“তবে অনেক মুসলমান লাইসেন্স ছাড়াই মদ পান করে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “দেশের ভেতর এর একটি চাহিদা আছে সেহেতু এর একটি বাজার তৈরি হয়েছে।”

তবে সবার পক্ষে আমদানি করা দামি মদ খাওয়া সম্ভব হয় না বলে বিভিন্ন হোমিওপ্যাথি দোকানদার এবং স্থানীয় মদ উৎপাদনকারীরা স্থানীয় মদের মধ্যে রেক্টিফাইড স্পিরিট মিশিয়ে বিশেষ ধরনের মদ তৈরি ও বিক্রি করে বলে জানান তিনি।

“এগুলো খেয়ে প্রতি বছরই অনেক মানুষ মারা যায়,” জানিয়ে শহিদুল হক বলেন, “মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উচিত এগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।”

তিনি বলেন, “সমাজে মদ নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোও এ ব্যাপারে কোনো কথা বলে না। এমনকি তাঁরা স্বীকারও করতে চান না যে পরিবারের কোনো সদস্য মদ খেয়ে মারা গেছেন।”

তবে প্রতি বছর বাংলাদেশে কত মানুষ ভেজাল মদ খেয়ে মারা যায় তা অধিদপ্তরের জানা নেই বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার।

“আমরা বিভিন্ন সময় মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করি,” বলেন মহাপরিচালক।

তিনি বলেন, “আমরা ইচ্ছা করলেও মদ বা গাঁজা বৈধ করতে পারব না। এগুলো বৈধ করার ব্যাপারে মূল অন্তরায় হলো আমাদের ধর্ম। দেশের আইন অনুযায়ী মদও মাদকের আওতায় পড়ে।”

তবে সচেতনতা সৃষ্টি হলে এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ হলে এমন সমস্যা থাকবে না বলে মনে করেন আহসানুল জব্বার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।