আগুনে পুড়ল ডিসিসি মার্কেট, নাশকতার অভিযোগ ব্যবসায়ীদের
2017.01.03

ভয়াবহ আগুনে রাজধানী ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশানের একটি বিশাল মার্কেট পুড়ে যাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, এটা নাশকতা ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করতেই পরিকল্পিতভাবে এই আগুন লাগানো হয়েছে।
তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় প্রশাসনের দাবি, এটা নিছক দুর্ঘটনা। একদিকে প্রায় ১৭ ঘন্টা ধরে আগুনে পুড়েছে এই মার্কেট, আরেকদিকে জোরদার হয়েছে নাশকতা ও দুর্ঘটনার বির্তক।
গত সোমবার দিবাগত রাতে লাগা ওই আগুনে মার্কেটের ৬৩৪টি দোকান পুড়ে গেছে। ধসে পড়েছে মার্কেটটির একাংশ। ব্যবসায়ীরা প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “কীভাবে আগুন লেগেছে, এটা নিছক দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিতভাবে কেউ আগুন লাগিয়েছে—এসব বিষয় তদন্ত করে খুঁজে বের করতে হবে।”
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিসের সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তর। তবে কেবল ফায়ার সার্ভিস নয়, পুলিশ, দোকান মালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি করার আহ্বান জানিয়েছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান।
গত সোমবার রাত দুইটার দিকে গুলশান ১ নম্বরের ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মার্কেটটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে মার্কেটের অধিকাংশ দোকান পুড়ে গেছে। প্রায় ৪০০ দোকানসহ ধসে পড়েছে মার্কেটের একাংশ। আগুন লাগার প্রায় ১৭ ঘণ্টা পরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস।
গত সোমবার রাত থেকে ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ করেছে বলে বেনারকে জানান ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) মেজর শাকিল নেওয়াজ। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ভেতরের আগুন পুরোপুরি নেভেনি বলে জানান তিনি।
পুরোনো বিরোধের জের ধরে পরিকল্পিতভাবে এ আগুন লাগানো হয়েছে মর্মে আশঙ্কা প্রকাশ করেন কাঁচা মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি শের মোহাম্মদ। গতকাল সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চারতলা একটা ভবন এত দ্রুত ধসে পড়ার বিষয়টা আমাদের অবাক করেছে। এটা নিশ্চিতভাবেই পরিকল্পিত ঘটনা।”
শুরু থেকেই আগুন নেভাতে গাফিলতি লক্ষ করা গেছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ফায়ার সার্ভিসের ২২-২৩টি ইউনিট কাজ করার কথা বললেও ওই সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে দুই–তিনটি দাবি করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন দোকান মালিকদের কেউ কেউ।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমদ খান বেনারকে বলেন, “মার্কেটে প্লাস্টিক, কসমেটিকস, রঙ, তেলের মতো দাহ্য পদার্থ বেশি থাকায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়া আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়েছে।”
ভয়াবহ এ আগুনে ব্যবসায়ীদের অন্তত পাঁচশ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে দাবি করেছেন শের মোহাম্মদ। সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের কোনো ঘোষণা গতকাল পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, মার্কেটটি প্রায় সাত বিঘা জমির ওপর গড়ে ওঠে। ১৯৬২-৬৩ সাল থেকে এর পাকা মার্কেট অংশটি রয়েছে। পরে ১৯৮২ সালের দিকে কাঁচা মার্কেটে দোকান বরাদ্দ দেয় সিটি করপোরেশন।
২০০৩ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ওই স্থানে ১৮ তলা ট্রেড সেন্টার নির্মাণের পরিকল্পনা নেন। এ ভবন নির্মাণে মেট্রো গ্রুপের সাথে একটি চুক্তি করে সিটি কর্পোরেশন। চুক্তিতে দোকান মালিকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
নতুন ভবন নির্মাণের জন্য মার্কেটটি ছেড়ে দিতে দোকান মালিকদের গত কয়েক বছর ধরে ম্রেট্রো গ্রুপ ও সিটি করপোরেশন একাধিকবার চাপাচাপি করেছে বলে অভিযোগ করেন ব্যবসায়ী শের মোহাম্মদ। এর বিরুদ্ধে ২০১০ সালে একটি মামলাও করেন ব্যবসায়ীরা।
দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি জয়নাল আবেদিন বেনারকে বলেন, মামলার কারণে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করতে না পেরে পরিকল্পিতভাবে মার্কেটে আগুন দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সিটি কর্পোরেশনের কেউ কেউ এবং মেট্রো গ্রুপ জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
তবে ডিএনসিসি মেয়র আনিসুল হক এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “কোনো ধরনের নাশকতা নয়, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুন লাগতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “স্বাভাবিকভাবে মনে হচ্ছে, ইলেকট্রিসিটি থেকেই আগুন লেগেছে। এখানে খাবার, পারফিউমসহ এতো বেশি দাহ্য পদার্থ যে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে গেছে।”
এদিকে ঘটনাস্থলে গতকাল ছিল দোকান মালিক ও তাদের স্বজনদের আহাজারি। অধিকাংশ ব্যবসায়ীই মালামাল সরাতে পারেননি।
সকালে চোখের সামনে জ্বলতে থাকা দোকানের সামনে আহাজারি করতে থাকা মসলার দোকানদার জুলহাস মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, “রিকশা চালিয়ে ও সবজি বিক্রি করে জমানো টাকা দিয়ে এই মার্কেটে দোকান দিয়েছিলাম। অথচ আগুনে জীবনের সব রোজগার শেষ হয়ে গেলো। একটা সুতোও দোকান থেকে বের করতে পারিনি।”