বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলে স্মরণকালের প্রাকৃতিক বিপর্যয়

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.04.21
ঢাকা
সুনামগঞ্জে হাওরের পানি কমলেও নষ্ট হয়েছে ধান। কৃষকেরা খেতের খড়কুটো খাওয়াচ্ছেন গরু দিয়ে। সুনামগঞ্জে হাওরের পানি কমলেও নষ্ট হয়েছে ধান। কৃষকেরা খেতের খড়কুটো খাওয়াচ্ছেন গরু দিয়ে। এপ্রিল ২০, ২০১৭।
স্টার মেইল

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার কারণে বৃহত্তর সিলেট, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ এলাকার প্রায় চার লাখ কৃষক পরিবার চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে। তাদের জীবিকার মূল অবলম্বন বোরো ধান ও মাছ দু-ই বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বছর বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হতে পারে।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মনজুরুল হান্নান বেনার নিউজকে জানান, “বর্তমান হিসাব অনুযায়ী এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া আকস্মিক বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার প্রায় দুই লক্ষ হেক্টর জমির বোরো ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এর ফলে এ বছর প্রায় তিন লক্ষ মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদন কম হতে পারে।”

বন্যার ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখ করে মহাপরিচালক বলেন, পানিতে আধা-পাকা বোরো ধান পচে গেছে। এতে কমপক্ষে চার লক্ষ কৃষক সর্বস্বান্ত হয়েছে।

উল্লেখ্য, হাওর অঞ্চলে বছরে শুধু বোরো ধানই উৎপাদন হয়। দেশের অন্য এলাকার মতো আর কিছুই উৎপাদন হয় না।

এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বেনার নিউজকে বলেন, বন্যা আক্রান্ত এলাকায় প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো হয়েছে। সরকার দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে।

“হাওর এলাকার মানুষের পুনর্বাসনের ‍জন্য সবকিছু করা হবে,” জানান দুর্যোগমন্ত্রী, যিনি ওই এলাকা পরিদর্শন করেছেন।

তবে নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে হাওর অধ্যুষিত বৃহত্তর সিলেটকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি উঠেছে।

“আমরা সরকারের কাছে ওই এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। সরকার যে ব্যবস্থা নিচ্ছে, তা দুর্যোগের প্রকোপ বিবেচনায় মোটেও যথেষ্ট নয়,” বেনারকে জানান নাগরিক উদ্যোগের আহ্বায়ক শরীফুজ্জামান শরীফ।

অবিলম্বে হাওর অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়ে গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ কৃষক সমিতি ও খেতমজুর সমিতি।

এদিকে গত ১৮ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ হাওর এলাকা ঘুরে দেখে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি ওই এলাকায় দেওয়া এক বক্তৃতায় বলেন, হাওরে এমন দুর্যোগ তিনি তাঁর জীবনে দেখেননি। রাষ্ট্রপতির বাড়িও হাওর এলাকায়, যেখান থেকে তিনি ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

সরকারিভাবে এ বছর দেশে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা এক কোটি ৮৮ লক্ষ মেট্রিক টন। গত বছর ওই লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি ৮৯ লক্ষ মেট্রিক টন। এবার প্রায় দুই লক্ষ হেক্টর জমির বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হতে পারে।

প্রতি বছরই প্রাকৃতিক কারণে পাহাড়ি ঢলে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর অঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়। তবে এই প্লাবন শুরু হয় মে মাসের শুরুর দিকে।

পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বেনার নিউজকে বলেন, বৃহত্তর সিলেট, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি রাজ্যের নিচে অবস্থিত।

তিনি বলেন, আসাম ও মেঘালয়ে বৃষ্টি শুরু হলে সেই পানি পাহাড়ি নদী হয়ে এসব জেলায় নেমে আসে। তবে, প্রতি বছর এই পাহাড়ি ঢল নামে মে মাসে। কৃষকেরা ঢল আসার আগেই বোরো ধান কেটে নেয়।

“কিন্তু এ বছর চার সপ্তাহ আগেই এই ঢল নেমেছে। বোরো ধান ডুবে গেছে। লক্ষ লক্ষ কৃষকের ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে,” বলেন ড. আইনুন নিশাত।

সুনামগঞ্জে হাওরের পানি পরীক্ষা করছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। এপ্রিল ২১, ২০১৭।
সুনামগঞ্জে হাওরের পানি পরীক্ষা করছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকরা। এপ্রিল ২১, ২০১৭।
স্টার মেইল
এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু কৃষকেরা নয়, জেলেরাও বিপাকে পড়েছে। পচা পানিতে মাছ মরে যাচ্ছে। একই সাথে হাঁস খামারি ও গরু-ছাগল পালনকারীরা বিপদে। গরু-ছাগলের রোগ বালাই বেড়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল বাসেত টেলিফোনে বেনার নিউজকে জানান, এ বছর অকস্মাৎ ঢলে ধানখেত পানিতে তলিয়ে গেছে। আর ধানগাছ পচে হাওরের পানিতে সাদা ফেনা বের হচ্ছে। পানি পচে টেংরা, পুঁটি, মলা, আইড়, বোয়ালসহ বিভিন্ন মাছ মরে ভেসে উঠেছে।

এদিকে হাওর এলাকায় মাছের মড়কের কারণ হিসেবে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। সরকারি এই সংস্থাটির একদল বিশেষজ্ঞ ১১ টি হাওরের মাছ ও পানির নমুনা পরীক্ষা করে এই মতামত দিয়েছেন। এ ছাড়া তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় হাওর অঞ্চলে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন।

মরা বিষাক্ত মাছ খেয়ে হাঁসও মারা যাচ্ছে বলে সুনামগঞ্জ জেলার মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ বেনার নিউজকে জানান।

বিএফআরআই এর বিজ্ঞানীরা গতকাল শুক্রবার হাওরে মাছের মৃত্যু নিয়ে করা তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছেন। এতে তারা বলেছেন, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে দশমিক এক থেকে দশমিক আট মিলিগ্রাম। সাধারণত নিরাপদ মাছ চাষের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে ৫-৮ মিলিগ্রাম থাকার কথা।

“আমরা হাওরবাসীরা বোরো ধান আর মাছ-এই দুইয়ের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করি। ধান গেল, মাছও মরে গেল। আমরা কীভাবে বাঁচব, জানি না,” বলেন আবুল বাসেত।

উল্লেখ্য, প্রতি বছর এপ্রিল-মে মাসে হাওরে মাছ ডিম ছাড়ে। আর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে জেলেরা সেই মাছ ধরে।

হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার রুয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সভাপতি শ্রীকান্ত সরকার বেনার নিউজকে বলেন, “আমাদের গ্রামের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ গরিব। এখানে ১১০টি পরিবার বাস করে। বোরো ধান আর মাছ দিয়ে তাদের জীবন চলে।”

“এ বছর ধান-মাছ সবই গেল। আমাদের জন্য দোয়া করবেন আমরা যেন বাঁচতে পারি,” জানান শ্রীকান্ত সরকার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।