কক্সবাজারে পাহাড় ধসে চার ভাইবোনসহ ৫ শিশু নিহত
2018.07.25
ঢাকা ও কক্সবাজার

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিধস পূর্বাভাস জারির একদিন পরেই কক্সবাজারে দুটি পৃথক পাহাড় ধসে একই পরিবারের চার ভাই বোনসহ পাঁচ শিশু নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস।
বুধবার কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া বাঁচা মিয়ার ঘোনা এলাকা এবং পার্শ্ববর্তী রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের পানিছড়া এলাকায় পৃথক পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে বলে বেনারকে জানিয়েছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরোজুল হক টুটুল।
এছাড়া, গত তিন দিনের বর্ষণে জেলার টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী ও কর্মকর্তারা।
কক্সবাজার জেলায় সোমবার থেকে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সোমবার সারাদেশে শুরু হওয়া প্রবল বর্ষণের মধ্যে মঙ্গলবার বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট এলাকায় ভূমিধসের সতর্কতা জারি করে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
সেই অনুসারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী মানুষদের বাড়ি থেকে সরে যেতে বলা হয়। কিন্তু তারা বাড়ি ছাড়তে রাজি হননি বলে সাংবাদিকদের জানান ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক সাফায়েত হোসেন।
নিহত যারা
বাঁচা মিয়ার ঘোনা এলাকায় বুধবার ভোরে বড় পাহাড় ধসের ঘটনাটি ঘটে। ওই ঘটনায় মালয়েশিয়া প্রবাসী জামাল হোসেনের চার সন্তান আব্দুল হাই (৬), খাইরুন্নেছা (৮), কাফিয়া আক্তার (১০) ও মর্জিয়া আক্তার (১৫) মাটি চাপা পড়ে নিহত হয়।
জামাল হোসেনের বাড়ি পাহাড়ের পাদদেশে।
ভোরে ঘটনার আগে নিহতদের মা ছেনুয়ারা বেগম বাড়ির দরজার কাছে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন বলে জানান ফায়ার সার্ভিস অফিসার সাফায়েত হোসনে। হঠাৎ উপর থেকে এক স্তর মাটি নিচে নেমে আসে। ঘুমন্ত ওই চার শিশু মাটির নিচে চাপা পড়ে। ছেনুয়ারা বেগমও এ ঘটনায় আহত হন।
ছেনুয়ারা বেগমের চিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে আসে এবং ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা এসে কাদামাটি সরিয়ে চার শিশুকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে।
তাদের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
পাহাড় ধসের অপর ঘটনাটি ঘটে রামু উপজেলার পানিছড়া এলাকায়। রামুর ওই ঘটনা ফায়ার সার্ভিসকে জানালে উদ্ধার কর্মীরা আসার আগেই স্থানীয়রা আহত শিশু মোরশেদ আলমকে (৬) উদ্ধার করেন। তবে তাকে বাঁচানো যায়নি। পিতা জাগির হোসেনও এই ঘটনায় আহত হন।
গত দুই দশকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট অঞ্চলে নির্বিচারে পাহাড়ি বন উজাড় ও পাহাড় কেটে স্থাপনা নির্মাণের কারণে ভূমি ধস ও পাহাড় ধসের ঘটনা বেড়ে চলেছে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ও ভূমি ধসে মানুষ মারা যায়। নিহতদের অধিকাংশই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ।
বাংলাদেশ-মার্কিন সহযোগিতায় পরিচালিত আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “পাহাড়ের গাছগুলো পাহাড়ের মাটি আটকে রাখে। কিন্তু দুঃখের বিষয় চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট এলাকায় অধিকাংশ পাহাড়ি বনভূমিতে গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আবার পাহাড় কেটে বাড়িঘর ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে পাহাড়ের কোনো ভারসাম্য নেই। বৃষ্টি সরাসরি মাটিতে পড়ে পাহাড় নরম হয়ে যাচ্ছে। ফলে পাহাড় ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটছে।”
গত বছর জুন মাসের মাঝামাঝি কয়েকটি পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি ও মৌলভীবাজার জেলায় ১৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকায় চলমান জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে পরিবেশ মন্ত্রী ও চট্টগ্রাম এলাকার সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বৃষ্টির মৌসুমে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, সিলেট ও অন্যান্য পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস হতেই পারে।
মন্ত্রী বলেন, “বিভিন্ন কারণে পাহাড় ধস হচ্ছে। বন-খেকোরা বন কেটে উজাড় করে ফেলছে, আবার কেউ বন সাফ করে জুমচাষ করছে। ফলে পাহাড়ের ওপরে মাটি আঁকড়ে রাখার গাছের শিকড় না থাকায় মাটি নরম হয়ে তা ধসে পড়ছে।”
তিনি জানান, পাহাড় ধস রোধে তাঁর মন্ত্রণালয় পাহাড়ে অধিক হারে গাছ লাগাতে ও বনের জমি ইজারা দেওয়া বন্ধ করতে প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “কক্সবাজারের রোহিঙ্গারা ৫ হাজার একর জমির গাছগাছালি উজাড় করে ফেলেছে। যেহেতু মানবিক কারণে তাঁদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছে সেহেতু এই ক্ষতি আমাদের মানতেই হবে।”
তিনি বলেন, কক্সবাজার বনাঞ্চলের বেশির ভাগ গাছ রোহিঙ্গারা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করছে। মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের জ্বালানি হিসাবে কয়লা দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা শিবিরে শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত
ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের শতাধিক ঝুপড়ি ঘর বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে টেকনাফে ৭০টি ও উখিয়ায় ৩০টি ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুল জামান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বুধবার টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে উখিয়ার তিন রোহিঙ্গা শিবিরে ৩০টির মতো ঝুপড়ি ঘর ভেঙে গেছে। তাঁদের এনজিওর সহযোগিতায় আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এখনো যারা অনিরাপদ স্থানে রয়েছে তাঁদের সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।”
উখিয়ার মধুরছড়ার রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা মোহাম্মদ সুলতান জানান, গত দুই দিনের ভারী বর্ষণে পাহাড়ি ঢালের আশ্রয় শিবিরের ২০টি ঘর ভেঙে গেছে। অনেক মানুষ গৃহহীন এবং পাহাড়ের নিচে বসবাসকারীরা পানি বন্দী হয়ে পড়েছে।
বালুখালী দুই নম্বর ক্যাম্পের আবু তাহের মাঝি বেনারকে জানান, পাহাড় কেটে এই শিবিরের অধিকাংশ ঘর তৈরি করা হয়েছে। বুধবার ভোর থেকে ভারী বর্ষণের ফলে পাহাড়ের খাদে ও ওপরে নির্মিত ১০টি ঘর ধসে পড়েছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে এসব পরিবার।
তবে এখনো কোনো রোহিঙ্গা শিবিরে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের। তিনি বেনারকে বলেন, “ভারী বৃষ্টিতে কয়েকটি শিবিরে সামন্য কিছু ঘর ভেঙ্গে যাবার খবর পেয়েছি। তবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।”
বুধবার টেকনাফে রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় ৭০টি ঘর ভেঙে গেছে বলে বেনারকে জানান টেকনাফ উপজেলার রোহিঙ্গা শিবিরের নেতা আলী জোহার।
তিনি বলেন, “টেকনাফে ১০টি রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে। তার মধ্যে ঝোড়ো হওয়ায় শালবাগান, পুটুবনিয়া ও লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ৭০টি ঘর ভেঙে গেছে। তাঁদের অন্যত্রে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।”