পদ্মার পেটে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ, প্রতিকার সামান্য

পুলক ঘটক
2018.09.14
ঢাকা
180914_River_erosion_1000.jpg পদ্মার ভাঙনের কবলে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮।
বেনারনিউজ

পদ্মার করাল গ্রাসে হারিয়ে যেতে বসেছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ। চোখের সামনে নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে বাড়িঘর, আবাদি জমি, বাজার, হাসপাতাল, সরকারি স্থাপনাসহ সবকিছু।

চেয়ে দেখা ছাড়া সেখানকার অসহায় মানুষদের কিছুই করার নেই। কাল যিনি ছিলেন স্বচ্ছল, আজ তিনি আশ্রয়হীন। তাঁদের সন্তানদের লেখাপড়াসহ ভবিষ্যতের সব সম্ভাবনা পদ্মায় তলিয়ে গেছে।

এই পরিস্থিতিতে সরকার ত্রাণ বিতরণসহ কিছু পদক্ষেপ নিলেও ভাঙন ঠেকানোর কার্যকর কোনও উদ্যোগ নেই। ভাঙন রোধে সরকার পদ্মা নদীর দক্ষিণ তীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্প গ্রহণ করলেও তা এখনই শুরু করা যাচ্ছে না। গত ২ জানুয়ারি এই প্রকল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা অনুমোদন হয়।

“প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। কিন্তু বর্ষার মধ্যে কাজ করা যাচ্ছে না। বর্ষা শেষ হলেই দ্রুততার সঙ্গে কাজ শুরু হবে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পরিচালনায় খুলনা শিপইয়ার্ডের মাধ্যমে কাজ করা হবে,” বেনারকে জানান শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম।

নড়িয়ার কেদারপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রফিক কাজী বলেন, “আমরা ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সঠিক সময়ে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি বলেই আজ এই দুরবস্থা।”

পানি উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেন সার্ভিসেসের হিসেবে, গত সাত বছরে নড়িয়ার প্রায় ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা নদীতে ডুবে গেছে। এর মধ্যে গত জুলাই থেকে ভেঙেছে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা।

গত আড়াই মাসে প্রায় সাড়ে চার হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছেন বলে বেনারকে জানান নড়িয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলার পাকা সড়ক, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা এবং উপজেলা হাসপাতালের মূলভবন ইতিমধ্যে নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। এভাবে ভাঙন চলতে থাকলে খাদ্যগুদাম এমনকি নড়িয়া পৌরভবনও টিকবে না বলে আশঙ্কা তাঁদের ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় ভাঙন থামানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। তবে ভাঙন ঠেকানোর কার্যক্রম চলমান রয়েছে দাবি করেছেন প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা। ঘরবাড়ি হারানো মানুষদের পুনর্বাসনেও সরকার সহায়তা করবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

সর্বস্ব পদ্মার পেটে

ভাঙনের কারণে নিঃস্ব ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, হাজার হাজার একর আবাদি জমি পদ্মার পেটে চলে যাওয়ায় নিঃস্ব হওয়া মানুষ হাহাকার করছে।

নদীতে ঘরবাড়ি হারানো প্রিয়ব্রত মজুমদার বেনারকে বলেন, “চোখের সামনেই সবকিছু নদীতে চলে গেছে। এখন আমি নিঃস্ব।”

এ বছর বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই প্রমত্ত পদ্মা ভাঙতে ভাঙতে দক্ষিণে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত চলে এসেছে। এতে গৃহহীন হয়ে পড়েছে সাড়ে চার হাজার পরিবার। এদের কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন।

নড়িয়া উপজেলার ৩শ’ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী মূলফৎগঞ্জ বাজারের প্রায় ৬শ’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাধুর বাজার ও ওয়াপদা বাজারের দুই শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ আশে পাশের সহস্রাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-দোকানপাট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কেউ কেউ তাঁদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিজেরাই ভেঙ্গে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।

ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তাদের খুঁটি তুলে অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ভাঙন কবলিত এলাকার।

ভাঙনে ৫ কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বাজার ও অবকাঠামো নিশ্চিহ্ন হওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। ২০টিরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় আসন্ন জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার্থীসহ বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছে।

৫০ শয্যা বিশিষ্ট নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূল ভবন নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, যে কোনো মুহূর্তে হাসপাতালের আরো ১২ টি ভবন নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।

শরীয়তপুরের সিভিল সার্জন ডা. খলিলুর রহমান বেনারকে জানিয়েছেন, “ভবনগুলো ঝুঁকিতে থাকায় হাসপাতালের মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম স্থগিত করতে হয়েছে। জরুরি ও বর্হিবিভাগের কিছু কার্যক্রম ডাক্তারদের আবাসিক কোয়ার্টারে চালু রাখা হয়েছে।”

বেসরকারি লাইফ কেয়ার হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারও সোমবার নদীতে বিলীন হয়েছে।

ত্রাণ কার্যক্রম

নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াসমিন বলেন, নদীর পাড়ের কাছাকাছি এলাকায় বসবাসরত মানুষকে নিরাপদ স্থানে যেতে বলা হয়েছে। ইতোপূর্বে প্রায় আড়াই হাজার ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। খুব শিগগির ৩৫০টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে দুই বান্ডিল করে টিন ও নগদ ৬ হাজার করে টাকা বিতরণ করা হবে।

তবে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, সহায়তা যা এসেছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কেদারপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছানা উল্লাহ মিয়া বলেন, “ইউনিয়ন পরিষদের কোনো তহবিল নেই; যা দিয়ে আমরা সাহায্য করতে পারি।”

সমস্যা পুরোনো, উদ্যোগ দেরিতে

সত্তরের দশক থেকে নড়িয়া ও জাজিরা এলাকায় পদ্মার ভাঙন শুরু হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৫ জুলাই গভীর রাত থেকে জেলার নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর ইউনিয়নে শুরু হয় পদ্মার সর্বগ্রাসী ভাঙন। বিরামহীন এ ভাঙন চলতে থাকে ২০১৭ সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত।

ভয়াবহ ভাঙনে গত দুই বছরে নড়িয়া ও জাজিরা উপজেলার কুন্ডেরচর, মোক্তারের চর, কেদারপুর ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভা এলাকার একটি বড় অংশ বিলীন হয়ে গেছে। এখন নড়িয়ার ভাঙন তীব্র।

ঝুঁকিপূর্ণ এই জনপদ রক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে অনেকদিন থেকে আন্দোলন করে আসছে এলাকাবাসী।

আন্দোলনকারীদের অন্যতম নেতা ইমাম হোসেন দেওয়ান বেনারকে বলেন, “বর্ষার আগেই স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিতে এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষ সড়ক অবরোধ ও মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণে আজ আমরা সর্বস্ব হারিয়েছি।”

এদিকে গত আগস্টে প্রকাশিত মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (নাসা) আর্থ অবজারভেটরি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পদ্মা নদীর তীব্র ভাঙনের দু’টি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত: এটি প্রাকৃতিক, মুক্ত প্রবাহিত নদী সুরক্ষার তেমন ব্যবস্থা নেই। দ্বিতীয়ত: নদীর তীরে একটি বড় বালুচর রয়েছে যা দ্রুতই ভেঙে যেতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাঙনে ১৯৬৭ সাল থেকে গত ৫১ বছরে ২৫৬ বর্গমাইলের বেশি জমি পদ্মার গর্ভে চলে গেছে। সময়ে সময়ে বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হলেও তা কার্যকর হয়নি বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।