ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় মার্কেটের ব্যবসায়ী ও বস্তির মানুষ

ঢাকা থেকে প্রাপ্তি রহমান
2017.02.09
গুলশান মার্কেটে ব্যবসায়ীদের সরকারি উদ্যোগে বাঁশের ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। পুড়ে ছাই হওয়া গুলশান মার্কেটে ব্যবসায়ীদের সরকারি উদ্যোগে বাঁশের ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৭।
প্রাপ্তি রহমান/বেনারনিউজ

গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে ঢাকায় বড় দুটি অগ্নিকাণ্ডের পেছনে নাশকতার অভিযোগ থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনোটিরই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি।

অন্যদিকে দুটি স্থানেই অস্থায়ীভাবে চলছে পুনর্বাসনের কাজ।

গত ৪ ডিসেম্বর মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে আগুন লেগে পুড়ে যায় অন্তত ৫০০ ঘরবাড়ি। তার একমাস পর ৩ জানুয়ারি আগুনে পোড়ে গুলশান-১ এর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) মার্কেটের ৬৩৪টি দোকান।

ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগার পর দোকানদারদের উচ্ছেদ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এ আগুন লাগানো হয়েছে মর্মে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে কাঁচা মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি শের মোহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চারতলা একটা ভবন এত দ্রুত ধসে পড়ার বিষয়টা আমাদের অবাক করেছে। এটা নিশ্চিতভাবেই পরিকল্পিত ঘটনা।”

কড়াইল বস্তির ১৭০ শতাংশ জমি বিটিআরসি, গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি। সরকারি তিনটি সংস্থাই সেখান থেকে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করছিল বহুদিন ধরে।

বস্তি উচ্ছেদে বিফল হয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে বস্তির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “আমাদের মন থেকে এই সন্দেহ দূর হয়নি, হবেও না।”

তবে আগুন লাগার ঘটনায় সরকারের বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি কাজ করলেও কোনো কমিটি নাশকতার বিষয়ে কোনো আভাস–ইঙ্গিত দেয়নি।

নগদ সহায়তা চান ব্যবসায়ীরা

ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগার পরপরই মেয়র আনিসুল হক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেন। সে অনুযায়ীই কাজ চলছে এখন।

প্রথম পর্যায়ে পুড়ে যাওয়া ২৯১টি স্থায়ী দোকানের মালিককে অস্থায়ী দোকান বরাদ্দ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যদেরও পুনর্বাসনের আওতায় আনা হবে বলে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান।

গত মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় মূল মার্কেটের বাইরে বাঁশের খুঁটি দিয়ে কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে। মেঝে বা দেয়াল এখনো ওঠেনি।

এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ফখরুল ইসলাম কিরণ বেনারকে জানান, “সরকার বাঁশ দিয়ে মূল মার্কেটের বাইরে ছোট দোকান করে দিচ্ছে। কিন্তু দোকানে বেচবটা কী? হাত তো খালি। অর্থ সহায়তা না দিলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে পথে বসা ছাড়া উপায় নেই।”

ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা দুটো বিষয় নিয়ে। দোকানের আকার এবং মালামাল ওঠানোর টাকা নিয়ে। কথা হচ্ছিল প্রসাধন সামগ্রী বিক্রেতা সাদির হোসেনের সঙ্গে।

“এখন যে জায়গা পাচ্ছি, আমার দোকানটা তার তিনগুণ ছিল। এইটুকু জায়গায় কতটা মালামাল তুলতে পারব তাই ভেবে পাচ্ছি না,” বেনারকে বলেন সাদির।

কমপক্ষে পাঁচজন ব্যবসায়ী জানালেন, ব্যবসা কবে আবার জমে উঠবে তা অনিশ্চিত। এ অবস্থায় পাইকারি বিক্রেতারা তাঁদের কাছে বাকিতে জিনিসপত্র বিক্রি করতে চাইছেন না। তাই এ মুহূর্তে তাঁরা মালামাল কেনার জন্য কিছু অর্থ সহায়তা চান।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, মার্কেটটি নিয়ে তাঁদের সুদূরপ্রসারী চিন্তা আছে।

“মার্কেটটির অবস্থা জরাজীর্ণ। আমরা বহুতল ভবন করার কথা চিন্তা করছি। সেখানে ব্যবসায়ীরা স্বচ্ছন্দে ব্যবসা করতে পারবেন,” বেনারকে জানান আমিনুল ইসলাম।

উল্লেখ্য, ষাটের দশকে মার্কেটটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিচেন মার্কেটের যে অংশে আগুন লাগে সেটি গড়ে ওঠে ১৯৮২ সালে।

কড়াইল বস্তিতে তোলা নতুন দোকানঘর। ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৭।
কড়াইল বস্তিতে তোলা নতুন দোকানঘর। ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১৭।
ছবি:প্রাপ্তি রহমান/বেনারনিউজ
আবারও তৈরি হচ্ছে কড়াইল বস্তি

তিন ঘণ্টার চেষ্টায় ফায়ার ব্রিগেড অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কড়াইল বস্তির আগুন নেভাতে পারলেও পুড়ে যায় পাঁচ শর ওপর দোকানপাট ও ঘরবাড়ি। গত মঙ্গলবার বস্তির বউ বাজার নামের যে জায়গাটিতে আগুন ধরেছিল, সেখানে গিয়ে নতুন স্থাপনা উঠতে দেখা গেছে।

বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় কারণে মালিকপক্ষের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা এই স্থাপনাগুলো তৈরি করছেন।

যে লেপের দোকান থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত সেটির সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল মুদি দোকানি মো. মণ্টু মিয়ার সঙ্গে। জমজমাট ব্যবসা ছিল তার। তিন ঘণ্টার আগুনে সব শেষ।

“যেই জায়গায় বসে আছি সেখানেই দোকান ছিল। মালপত্র সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে,” বেনারকে জানান মন্টু।

এ প্রতিবেদকের সঙ্গে মন্টু যখন কথা বলছিলেন তখন তিনি পান–সিগারেট বিক্রি করছিলেন। দোকান প্রায় ফাঁকাই।

ঘটনার পর অবশ্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্রত্যেককে দুই মণ করে চাল দিয়েছে। তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, তাঁরা যা হারিয়েছেন, তার তুলনায় পেয়েছেন সামান্যই।

কাছিরন বাসা বাড়িতে ঠিকে ঝি এর কাজ করেন। তিনি বলছিলেন, এক কাপড়ে অনেক দিন কাটাতে হয়েছে। স্কুল পড়ুয়া দুই মেয়ে রোজিনা ও খাদিজার বই-খাতা পুড়ে গিয়েছিল। পরনের কাপড় ছিল না। এখন নতুন করে জিনিসপত্র জোগাচ্ছেন।

তদন্ত চলছে

গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে আগুন লাগার কারণ খতিয়ে দেখতে একাধিক কমিটি গঠন করা হয় ঘটনার পরপরই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, পুলিশের দুটি বিশেষ শাখা সিআইডি এবং এসবি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা খতিয়ে দেখছে।

এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কেউ কিছু জানাতে পারেনি। তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সিআইডি ঘটনাস্থলের মাটি ও অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করেছেন। নাশকতা কি না তা পরীক্ষা করে দেখবেন।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স পরিচালক শাকিল নেওয়াজ বলছেন, মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

“প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। মার্কেটটির অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত ছিল। কিন্তু যেসব পণ্য ছিল তা খুবই দাহ্য প্রকৃতির,” বেনারকে জানান শাকিল নেওয়াজ।

অন্যদিকে কড়াইল বস্তির আগুন লাগার ঘটনাও ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স তদন্ত করছে বলে বেনারকে জানান শাকিল নেওয়াজ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।