মাদক বিরোধী অভিযানের প্রথম সপ্তায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ২৬
2018.05.21
ঢাকা
সরকার ঘোষিত মাদক বিরোধী যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে সারা দেশে কমপক্ষে ২৭ জন নিহত হয়েছেন। সরকারি তথ্যানুযায়ী, এদের ২৬ জনই র্যাব–পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন, একজন মারা গেছেন পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পানিতে ডুবে।
তবে চলমান বিচারবহির্ভূত হত্যা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের মানবাধিকার কর্মীরা। মাদক নির্মূলের এই পন্থায় আশাবাদী নন তাঁরা।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বেনারকে বলেন, “যারা আসল অপরাধী তারা সামনে আসছে না। তাদের কোনো পরিচয়ও জানা যাচ্ছে না। তা ছাড়া বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাই সমর্থনযোগ্য নয়।”
“এটা গডফাদারদের আড়াল করার ষড়যন্ত্র বা কৌশল কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা দরকার,” চলমান অভিযান সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে মত দেন আরেক মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত রোববার বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সারা দেশে অভিযান চলছে।”
“যত দিন পর্যন্ত না মাদক ব্যবসা ও সেবন নির্মূল হয়, এটা অব্যাহত রাখা হবে” জানান তিনি।
একই দিনে এক অনুষ্ঠানে ‘মাদক নির্মূলে অভিযান চলছে’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীও জানান, যেভাবে জঙ্গিবাদ দমন করা হয়েছে, একইভাবে মাদকের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করা হবে।
প্রসঙ্গত, জঙ্গি বিরোধী অভিযানেও র্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে বহু মানুষ নিহত ও গুম হয়েছেন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত এক হাজার ১৭০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। হয়েছেন ৩৪৭ ব্যক্তি।
এক সপ্তায় ১৬ জেলায় নিহত ২৭
র্যাব-পুলিশের দাবি অনুযায়ী, গত সোমবার (১৪ মে) থেকে শুরু হওয়া মাদক বিরোধী যুদ্ধে এখন অবধি ১৬ জেলায় নিহত ২৭ জনের মধ্যে ২৩ জন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। এর মধ্যে শুধু যশোরে সর্বাধিক সাত জন মারা গেছেন।
গত রোববার দিবাগত রাতে, অর্থাৎ সোমবার প্রথম প্রহরে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ নরেন্দ্রপুর, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, নরসিংদীর ঘোড়াশাল, গাজীপুরের টঙ্গী ও রাজশাহীর বেলপুকুরে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন নিহত হন।
একই রাতে যশোর সদর উপজেলার দুই এলাকা থেকে আরও তিনজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিজেদের মধ্যে গোলাগুলিতে তারা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়। রোববার বিকেলে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে পুলিশের ধাওয়ায় ঝিলে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু হয় এক তরুণের। এই দশ জনের প্রত্যেকে মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি করা হয়েছে।
শনিবার রাতে যশোর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর ও ফেনী জেলায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন নিহত হয়েছেন। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী এদের মধ্যে চারজনই মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত।
শুক্রবার রাতেও মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে যশোর ও ময়মনসিংহে র্যাব পুলিশের দুই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ চারজন নিহত হন। এদের মধ্যেও যশোরে নিহত তিনজন মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন বলে গণমাধ্যমকে জানানো হয়।
বৃহস্পতিবার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একব্যক্তি নিহত হন। একই রাতে চট্টগ্রাম নগরে আরও দুজন সন্দেহভাজন মাদকসন্ত্রাসী নিহত হন।
বৃহস্পতিবার রাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক জন এবং চট্টগ্রাম নগরে আরও দুজন সন্দেহভাজন মাদক সন্ত্রাসী নিহত হন।
এর আগে বুধবার রাজশাহী, মঙ্গলবার ফেনী এবং গত সোমবার দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জ ও কুষ্টিয়ায় মোট চার ব্যক্তি বন্দুকযুদ্ধের শিকার হন। যার মধ্যে তিনজনকে মাদক ব্যবসায়ী বলা হচ্ছে।
গত ১৪ মে এক সংবাদ সম্মেলনে মাদক বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চালানোর ঘোষণা দেন র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। সেদিন তিনিও বলেন, “মাদক ও জঙ্গি অপরাধ অন্য কোনো অপরাধের মতো নয়।”
মাদক সেবন ও ব্যবসায় জড়িতদের কঠোরতম ব্যবস্থার মুখোমুখি করার হুঁশিয়ারিও দেন তিনি। ওই দিন থেকেই বন্দুকযুদ্ধের প্রকোপ বেড়ে যায়।
‘সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস দমন হয় না’
চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেন, “মাদক একটা ভয়ানক সামাজিক সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। এটা নিয়ন্ত্রণ করাও দরকার। তবে সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাস দমন হয় না।”
“বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বা আইনি যে উপায় আছে, সেই উপায় গ্রহণ করাই সমীচীন।”
“কথিত সন্দেহভাজনদেরও মেরে ফেলা হচ্ছে বিধায় অপরাধের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে না,” দাবি করে নূর খান লিটন বলেন, “ওদের জীবিত ধরতে পারলে মূল হোতাদের নাম পাওয়া যেত।”
তার অভিমত, “এভাবে ঘোষণা দিয়ে অভিযান পরিচালনার মধ্য দিয়ে যারা ‘চাঁই বা নেতা’, সেই সব চোরাকারবারিদের আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে কিনা সেটাও দেখার ব্যাপার।”
“এমন ঘোষণায় তারা এমনিতেই সতর্ক হয়ে যাবে। যে কারণে তাদের আর বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না,” বলেন আসক’র এই সাবেক কর্মকর্তা।
ইতিমধ্যে জনসচেতনতা বাড়াতে রোববার থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশে র্যাবের উদ্যোগে ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান সংবলিত পোস্টার, লিফলেট বিলি শুরু হয়েছে।
এই কর্মসূচি উদ্বোধনকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “মাদকবিরোধী অভিযানে কাউকে ছাড় দেবে না সরকার।”
নূর খান বেনারকে বলেন, “যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, এমনকি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও মাদক ব্যবসায় সম্পৃক্ততার খবর দেখেছি, সেখানে এভাবে মাদকমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।”
তাঁর মতে, “সমাজের জনগণকে আগে সচেতন করতে হবে। সামাজিক শক্তিগুলোকে মাদকের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে হবে।”
সুলতানা কামাল বলেন, “একটি অপরাধ দমনে আরেকটি অপরাধ করার এই ধরনের চর্চা আশা করি শিগগিরই বন্ধ হবে।”