মাদক বিরোধী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এক রাতেই নিহত ১১
2018.05.22
ঢাকা

মানবাধিকার কর্মীদের তীব্র সমালোচনার মুখেও দেশজুড়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা অব্যাহত রয়েছে। সোমবার দিবাগত রাতে, অর্থাৎ মঙ্গলবার প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নয় জেলায় আরো ১১ জন নিহত হয়েছেন।
গত সপ্তাহে সরকার ঘোষিত মাদকবিরোধী যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এটাই এক রাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক হত্যার ঘটনা। এরই মধ্যে সরকারের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির অঙ্গ-সংগঠন ছাত্রদলের এক নেতা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় শুরু হয়েছে নতুন রাজনৈতিক বিতর্ক।
“সরকার টার্গেট করে বিরোধী নেতাকর্মীদের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করে মেরে ফেলছে,” এমন অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসিচব রুহুল কবির রিজভী।
মাদক নির্মূলের নামে বিচারবর্হিভূত হত্যার যে হিড়িক চলছে তাতে গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আছে বলে তাঁর অভিযোগ। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের দাবি, যাদের ধরা হচ্ছে তারা শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী।
বিগত সাত রাতের (১৪ মে দিবাগত রাত থেকে ২১ মে দিবাগত রাত অবধি) ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৯ জেলায় মোট ৩৭ জন মারা গেছেন। যার মধ্যে ৩৩ জন মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিলেন বলে দাবি করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা।
এছাড়া অভিযান চলাকালে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে রাজধানীর এক তরুণ মাদক ব্যবসায়ী। সব মিলিয়ে সোমবার সকাল অবধি মাদকবিরোধী যুদ্ধ নিহতের সংখ্যা ছিল ১৬ জেলায় ২৭ জন।
মাত্র ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে ঢাকায় পানিতে ডুবে নিহত তরুণসহ নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩৮ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে যশোরে সর্বাধিক সাত জন মারা গেছেন।
বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা এভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় আতঙ্কিত মানবাধিকার কর্মীরাও।
মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বেনারকে বলেন, “প্রতিটি হত্যার নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে এসব ঘটনা ঘটছে সেটা জানার অধিকার আমাদের আছে।”
“এক্ষেত্রে রাষ্ট্রেরও জানানোর দায়িত্ব রয়েছে,” যোগ করেন বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা।
আরেক মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “অনেকে মনে করেন বিচারবহির্ভূত হত্যার মধ্য দিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ে কিছু একটা অর্জন করা সম্ভব। সেই চিন্তা থেকেই এর সূচনা।”
“কিন্তু ফলাফল যে শূন্য তা গত দশ-পনেরো বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পেরেছি। বরং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জবাবদিহিতার উর্ধ্বেই থেকে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ২১ মে পর্যন্ত ১০২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
সোমবার গভীর রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত নিহতদের মধ্যে কুমিল্লা ও নীলফামারীর দুই জন ছাড়াও চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা, চুয়াডাঙ্গা, ফেনী, দিনাজপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নারায়ণগঞ্জের একজন করে মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন।
তবে নেত্রকোনায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছাত্রদলের সদস্য আমজাদ হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে রুহুল কবির রিজভী আরো বলেন, “বেআইনিভাবে মানুষ হত্যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাত্যহিক কাজে পরিণত হয়েছে।”
অন্যদিকে আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের জীবন বাঁচাতে বন্দুকযুদ্ধে বাধ্য হচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে কোনও ছাড় নয়, জিরো টলারেন্স নীতিতে তারা সামনের দিকে এগুচ্ছে।”
বিচারবহির্ভূত হত্যার সমালোচনা
মাদক বিরোধী যুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে-বিপক্ষে দেশজুড়ে তুমুল আলোচনা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠনগুলো। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিতর্ক চলছে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, “একটা গণতান্ত্রিক সমাজে সম্ভাব্য অপরাধী বা অভিযুক্তকে রক্ষা করার দায়িত্বও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বর্তায়।”
“যে কোনো অভিযান অবশ্যই আইনের ভিতরে থেকে পরিচালিত করতে হবে। এভাবে ঘোষণা দিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি করে অপরাধ দমন করা যাবে না,” বলেন আসক’র এই সাবেক নির্বাহী পরিচালক।
আরেক মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, “তাঁরা (র্যাব-পুলিশ) বলে থাকেন তাঁদের যে আগ্নেয়াস্ত্র দেয়া হয়েছে তা সাজিয়ে রাখার জন্য দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন তাঁরা এগুলো নিয়মনীতি মেনে ব্যবহার করছেন কি’না।”
“যেভাবে বন্দুকযুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে, সেই যুদ্ধের পরিস্থিতি কীভাবে উদ্ভুত হচ্ছে, তা বের করে দেখা উচিত সেখানে আসলেই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার মতো পরিস্থিতি হয়েছিল কি’না,” বলেন তিনি।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “শতভাগ নিশ্চিত হয়ে এবং তথ্য-প্রমাণ হাতে নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের নক করা হচ্ছে। কখনও কখনও তারা পালিয়ে যাওয়ার সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর গুলি ছোড়ে।”
“তখন জীবন বাঁচাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও পাল্টা গুলি ছোড়ে। যে কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে,” বলেন তিনি।
অন্যদিকে “অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করুন,” উল্লেখ করে রিজভী প্রশ্ন রাখেন, “মাদকের আসল গডফাদারদের ধরছেন না কেন?”
আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “মাদকের কোনও চুনোপুঁটিদের ধরা হচ্ছে না। চুনোপুঁটিদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে না।”
নূর খান লিটনের অভিমত, “এ ধরনের অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকা উচিত। আমরা (মানবাধিকার কর্মীরা) এ নিয়ে বলেই যাচ্ছি, কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।”
আর সুলতানা কামালের বক্তব্য, “জনগণের করের পয়সায় কেনা সরকারি অস্ত্র সংবিধান ও আইন মেনে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও কিন্তু রাষ্ট্রের।”