নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত মাদকবিরোধী ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ চলবে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.05.29
ঢাকা
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হাতে আটক কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক সেবী। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হাতে আটক কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক সেবী। ২৮ মে ২০১৮।
বেনারনিউজ

সরকার ঘোষিত মাদকবিরোধী যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহে ১১২ জন মাদক ব্যবসায়ী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। আটক হয়েছেন নয় হাজারের বেশি মানুষ।

চলমান এই অভিযানকে ‘মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করে তা ‘আগামী নির্বাচন পর্যন্ত চলতে পারে’ বলে বেনারকে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

গত ১৪ মে দিবাগত রাত থেকে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। সরকারি হিসাবেও মঙ্গলবার অবধি নিহতের সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে।

পুলিশ ও এলিট ফোর্স র‌্যাব বলছে, অভিযানে নিহতরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। আবার অনেকেই নিজেদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় নিহত হয়েছেন।

তাঁরা সকলেই চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক পাচারকারী এবং তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় অনেক মামলা রয়েছে বলে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দুটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।

তবে মানবাধিকার কর্মী ও বিরোধী দলের অভিযোগ, সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মাদক বিরোধী অভিযানের নামে নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। দেশে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আগামী নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় যাওয়াই এ অভিযানের উদ্দেশ্য।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, “মাদকবিরোধী অভিযানের নামে সরকার ‘পাখির মতো মানুষ মারছে’।”

র‌্যাব-পুলিশের বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে বেনারের তৈরি হিসাব অনুযায়ী সরকার ঘোষিত মাদক বিরোধী যুদ্ধের প্রথম দুই সপ্তাহে (১৫ মে থেকে ২৯ মে) দেশের ৪০ জেলায় মোট ১১৩ জন মাদক ব্যবসায়ী বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে একজন ধাওয়ার মুখে ঝিলের কাঁদাপানিতে ডুবে মারা গেছেন।

বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের মধ্যে কুমিল্লা জেলায় সর্বোচ্চ ১২ জন মারা গেছেন। এরপরই যশোরের অবস্থান। সেখানে নয় জন এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ফেনী ও কুষ্টিয়ায় ছয় জন করে মাদক ব্যবসায়ী মারা গেছেন।

ময়মনসিংহ ও সাতক্ষীরায় পাঁচ জন করে, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহ, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও কক্সবাজারে চার জন করে এবং ঢাকা, চুয়াডাঙা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা ও চাঁদপুরে তিন জন করে মারা গেছেন।

পিরোজপুর, বরগুনা, মাগুরা, গাইবান্ধা, রাজশাহী, টাঙ্গাইল ও নীলফামারী দুই জন করে এবং পাবনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, মুন্সীগঞ্জ, নোয়াখালী, মেহেরপুর, বাগেরহাট, খুলনা, জয়পুরহাট, কুড়িগ্রাম, শেরপুর, রংপুর, নরসিংদী, গাজীপুর, লালমনিরহাট ও জামালপুরে একজন করে নিহত হয়েছেন।

‘মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমাদের চলমান অভিযান হলো ‘মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ’। এই অভিযান চলবে। ঈদ পর্যন্ত বা ‍নির্বাচন পর্যন্ত বলে কোনো কথা নেই। যত দিন এটা নিয়ন্ত্রণে না আসবে তত দিন অভিযান চলবে।”

তিনি বলেন, “সরকারের তালিকা অনুযায়ী মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অভিযান পরিচালনার জন্য কোনো দলকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের দলের মানুষও অভিযানে নিহত হয়েছে।”

“পুলিশ-র‌্যাব অভিযান পরিচালনার সময় আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালাবেই,” এমন মন্তব্যও করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

মাদকের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরে আসাদুজ্জামান খান বলেন, “একজন মাদকাসক্ত মেয়ে নেশায় আসক্ত হয়ে তার নিজের বাবা-মাকে হত্যা করেছে। মাদক আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যেকোনো ভাবেই হোক মাদক নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার।”

বিরোধী দলের অভিযোগ অস্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “মাদকের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। তারা (বিএনপি) তো অনেক কিছুই বলে। দেশের যুব সমাজকে রক্ষার জন্য অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে; অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। নির্বাচনের সাথে এটার কোনো সম্পর্ক নেই।”

বাংলাদেশে মূল মাদক সমস্যা হলো মিয়ানমার থেকে পাচার হয়ে আসা ইয়াবা ট্যাবলেট। এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিবেশী মিয়ানমারের সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ইয়াবার একমাত্র উৎস হলো মিয়ানমার। এই মাদক নির্মূলে আমরা মিয়ানমারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাচ্ছি না। আমাদের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাথে মিয়ানমারের মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নিয়মিত বৈঠকে করে। কিন্তু তারা কোনো সভার সিদ্ধান্তে সই করে না।”

টেকনাফ ও বান্দরবান জেলার ইয়াবা ব্যবসায়ীরা মাদক বিরোধী অভিযান থেকে বাঁচতে মিয়ানমারে পালিয়ে গেছেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, “আমরা বিষয়টি মিডিয়া থেকে জেনেছি।”

নয় হাজারের বেশি গ্রেপ্তার

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, ২৮ মে পর্যন্ত মোট এক’শ জন মানুষ সারা দেশে নিহত হয়েছেন। অধিকাংশ তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলো ঘটে গভীর রাতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাদক বিরোধী অভিযান তদারকি করছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “গোয়েন্দাদের তৈরি করা জেলাওয়ারি মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সেই তালিকা ধরেই মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।”

পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহেলী ফেরদৌস মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “মাদকবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত নয় হাজারের মতো মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাদক সংক্রান্ত মামলা দায়ের করা হয়েছে প্রায় সাত হাজার।”

এ ছাড়া প্রায় ৪২ কোটি টাকা মূল্যের মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত মাদকের প্রায় অধিকাংশই ইয়াবা বলে তিনি জানান।

সহেলী জানান, ১৪ মে শুরু হওয়া অভিযানে ১৭ লাখ পিস ইয়াবা, দুই হাজার ২৮৬ কেজি গাঁজা, দেশি মদ ৫৫ হাজার লিটার, ২৩ কেজি হেরোইন, ১৬ হাজার ফেনসিডিল ও বিদেশি বিয়ারের ক্যান এক হাজার ২১০টি উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া, অভিযানে মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল ও বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়েছে।

ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগ

এদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বেনারকে বলেন, “সরকারের মাদক বিরোধী অভিযান মাদকের বিরুদ্ধে নয়। যেভাবে তারা ক্রসফায়ারের নামে মানুষ মারছে সেটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।”

তিনি বলেন, “সরকারের এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মাদক ব্যবসার গডফাদারদের রক্ষা করা হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তাদের ধরে তাদের কাছ থেকে মূল মাদক ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে তথ্য পেতে পারে পুলিশ। তাদের দেওয়া তথ্য অনুসারে প্রকৃত দোষীদের বের করা সম্ভব।”

ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, “যেভাবে এই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে তা দেশের মানুষ মনে করে আগামী সংসদ নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসার জন্য দেশে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায় সরকার। এই অভিযানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে আমরা মনে করি।”

আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেশের সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমরা বারবার বলছি এভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে দেওয়া হলে রাষ্ট্র থাকে না।”

তিনি বলেন, “অচিরেই এ ধরনের ‘বন্দুকযুদ্ধের’ অবসান হওয়া জরুরি। অন্যথায় দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বলে কিছুই থাকে না।”

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শরীফ খিয়াম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।