কড়া সমালোচনার মুখে কমলো ‘বন্দুকযুদ্ধ’

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.06.04
ঢাকা
মাদক বিরোধী অভিযানের নামে চলমান বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন। মাদক বিরোধী অভিযানের নামে চলমান বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন। ৩ জুন ২০১৮।
বেনারনিউজ

কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভা কাউন্সিলর একরামুল হকের মৃত্যুর আগে তাঁর কন্যা ও স্ত্রীর সাথে কথোপকথনের অডিও প্রকাশ হওয়ার পর গত দুদিন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যুর ঘটনা কমে এসেছে।

১৪ মে মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে সারা দেশে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৩০ জন অভিযুক্ত মাদক ব্যবসায়ী পুলিশ ও র‌্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। এসব হত্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যেমে কড়া সমালোচনা হচ্ছে।

পুলিশ বলছে, সর্বশেষ গত রোববার দুটি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেছে, টাঙ্গাইল ও রংপুরে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হতাহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিটি ঘটনা তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।

দেশের দশ শীর্ষ বুদ্ধিজীবী ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করে সেগুলো বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিতর্ক এড়াতে সাবধানতার সাথে চলমান মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে বলেছে।

সব মিলিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কড়া সমালোচনার মুখে সরকার। তবে সরকার বলছে, চলমান মাদক বিরোধী অভিযান চলবে। সেক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, মাদক বিরোধী অভিযানে কোনো বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেনি।

মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বেনারকে বলেন, “দেশে চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে জানতে পেরে আমি নিজে ২৯ মে তারিখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি দিয়েছি।”

তিনি বলেন, “মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনার সময় মানবাধিকার রক্ষার দিকে যাতে নজর দেওয়া হয় সেজন্য আমি তাঁকে আহ্বান জানিয়েছি। আমি বলেছি, প্রতিটি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা যেন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তদন্ত করা হয় ও তদন্তে যদি কেউ দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে যেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”

কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা বলেছি। দেশের বুদ্ধিজীবীরাও বলেছেন। সেকারণেই হয়তো আরও সাবধানতার সাথে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে; গত কয়েক দিন আমরা প্রাণহানি দেখছি না।”

তিনি বলেন, “প্রতিটি নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় এতে বিচার করা হোক।”

একরামের মৃত্যু: র‌্যাবের তদন্ত কমিটি

টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক গত ২৬ মে টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন বলে র‌্যাব দাবি করে।

তবে একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম গত ৩১ মে কক্সবাজারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে অভিযোগ করেন যে তাঁর স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে র‌্যাব সদস্যরা হত্যা করেছে। প্রমাণ হিসেবে তিনি একরামের সাথে তাঁর ও মেয়ের কথোপকথনের একটি অডিও ক্লিপ উপস্থাপন করেন।

ওই কথোপকথনে একরামকে গুলি করা ও তারপর মৃত্যুর আগে গোঙানি শোনেন আয়েশা বেগম।

র‌্যাব এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, একরাম মাদক ব্যবসায়ী ও তিনি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন।

র‌্যাব মুখপাত্র মুফতি মাহমুদ খান সোমবার বেনারকে বলেন, “আমরা (একরামের মৃত্যু তদন্ত করতে) তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। এর বাইরে কিছু বলব না।”

তিনি বলেন, চলমান মাদক বিরোধী অভিযান চলছে ও চলবে। গত কয়েকদিনে উদ্ধার ও “বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা কমেছে। কারণ, মাদক ব্যবসায়ীরা পালিয়ে গেছে।”

এদিকে একরাম ছাড়াও গাজীপুর শহরের ভাদুন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কামাল ইসলাম ওরফে কামু নামে আরেকজনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। নিহতের স্ত্রী আছমা বেগম বেনারকে বলেন, “বৃহস্পতিবার (৩১ মে) ভোর পাঁচটার দিকে কামুকে বাড়ি থেকে ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। পরে হত্যা করা হয় আমার স্বামীকে।”

পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে কামু একজন মাদক ব্যবসায়ী। সে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে।

‘সরকার ব্যাকফুটে’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পলিটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান বেনারকে বলেন, “দেখুন আওয়ামী লীগ বলেছিল যে মাদক বিরোধী অভিযানে দেশের মানুষ খুশি। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হলো দেশের মানুষ এগুলো গ্রহণ করেনি। রোজার মাসে আপনি মানুষ মারবেন এটা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।”

তিনি বলেন, “টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক হত্যার প্রমাণ মিডিয়াতে চলে আসার কারণে দেশের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে আওয়ামী লীগ যা করছে সেগুলোর সবকিছুই পারপাসফুল।”

ড. আতাউর বলেন, “আর সেকারণে সরকার এখন ব্যাকফুটে। গত দুদিনে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে জনপ্রিয়তা মাথায় রেখে ফিলিপাইনের আদলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই অভিযান শুরু করা হয়। তবে, এই অভিযান করে সরকারের রাজনৈতিক লাভের পরিবর্তে ক্ষতি হয়েছে, আমি বলব।”

ড. আতাউর বলেন, “দেশের শীর্ষ ১০ বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিয়ে মাদক বিরোধী অভিযানের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। দেশের মানুষ তাঁদের কথা শুনেছেন।”

তিনি বলেন, “সরকার হয়তো কিছুদিন পর আরেকভাবে মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করবে।”

‘রাষ্ট্রের ক্ষমা চাওয়া উচিত’

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “মাদক ব্যবসায়ী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের আপত্তি হলো যেভাবে এটা পরিচালনা করা হচ্ছে সেটাকে নিয়ে।”

তিনি বলেন, “ভালো কাজ মন্দভাবে করা সমর্থনযোগ্য নয়। ভালো কাজ ভালোভাবেই করতে হবে। আইন অনুসারে করতে হবে।”

ড. মিজানুর রহমান বলেন, “আমরা বারবার বলেছিলাম এ ধরনের অভিযান হলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটবে। একরাম ও গাজীপুরে কামু হত্যাকাণ্ড আমাদের শঙ্কাকে প্রমাণ করেছে।”

তিনি বলেন, “এখন রাষ্ট্রের উচিত যে ভুলগুলো হয়েছে সেগুলো স্বীকার করে নিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া।”

ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ

মাদকবিরোধী অভিযানে বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ঢাকায় কর্মরত ইইউভুক্ত আটটি সদস্য দেশের কূটনীতিকরা এক যৌথ বিবৃতিতে যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে প্রতিটি হত্যকাণ্ডের তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।

ঢাকায় ইইউ দূতাবাস সোমবার রাষ্ট্রদূতদের ওই বিবৃতি প্রচার করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আইনের শাসন সমুন্নত রাখা এবং বলপ্রয়োগের সময় সুরক্ষা নিশ্চিতসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পদক্ষেপে আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলার ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইইউ আশা করে, কর্তৃপক্ষ যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অভিযুক্ত অপরাধীদের প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবে।

বিবৃতিতে সই করেন ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনসে টেরিঙ্ক, ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা, জার্মানির রাষ্ট্রদূত টমাস প্রিনজ, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেইক, ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত মিকেল হিমনিটি উইন্টার, স্পেনের রাষ্ট্রদূত ইভারো ডি সালাস, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত শারলোটা স্কালাইটার, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারি আনিক বোখদা। এছাড়া ইইউর অংশীদার দেশ হিসেবে বিবৃতিতে সই করেন ঢাকায় নরওয়ের রাষ্ট্রদূত সিসেল ব্লিকেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।