চা বিক্রেতা নারীকে ক্রসফায়ারের হুমকি, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা

কামরান রেজা চৌধুরী
2018.06.05
ঢাকা
ঢাকায় বাংলাদেশ পুলিশের মাদক বিরোধী অভিযান। ঢাকায় বাংলাদেশ পুলিশের মাদক বিরোধী অভিযান। ৫ জুন ২০১৮।
বেনারনিউজ

টাকা না দিলে মাদক মামলায় জড়িয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখানোর অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চার সদস্যের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার ঢাকার একটি আদালতে মামলা করেছেন মাকসুদা বেগম নামের পঞ্চাশোর্ধ এক চা বিক্রেতা নারী।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, ঢাকার ভাটারা থানার এসআই হাসান মাসুদের নেতৃত্বে চার পুলিশ সদস্য গত মে মাসে মাসোহারা ও ঈদ বোনাস বাবদ ১০ হাজার টাকা না দিলে ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়ার হুমকি দেন। টাকা না দেওয়ায় তাঁরা মাকসুদা বেগমের চা দোকান ভাঙচুর করেন।

এ ঘটনায় মামলা করতে গেলে পুলিশ তাঁদের ভাটারা থানায় প্রবেশ করতে দেয়নি। এর প্রেক্ষিতে বাদী মাকসুদা বেগম আদালতে মামলা করতে গেলে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেন টিপুর আদালত মামলাটি গ্রহণ করেন।

বিচারক টিপু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (উত্তর) উপ-কমিশনারকে অভিযোগ তদন্ত করে আগামী ৪ জুলাই তারিখের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন বাদীর আইনজীবী মাহবুব রানা।

তবে ভাটার পুলিশ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

গত ১৪ মে মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরুর পর এটি পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে দ্বিতীয় মামলা দায়েরের ঘটনা। গত রোববার নরসিংদীতে সোমা বেগম নামে এক নারী পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। অভিযোগে তিনি বলেন, দুই লাখ টাকা চাঁদা না দেওয়ায় জেলার মনোহরদী থানার পুলিশ তাঁর স্বামী আবুল কালামকে মাদকের মামলায় ফাঁসিয়েছে।

ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কালামের কাছ থেকে মাদক ব্যবসার সাথে তাঁর সম্পৃক্ততার ব্যাপারে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় বলে মামলার এজাহারে অভিযোগ করেন সোমা বেগম।

চলমান এই অভিযানে সারা দেশে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৩৪ জন অভিযুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবী ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনায় নিহত হয়েছেন। এরই মধ্যে কিছু অভিযোগ উঠছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মানুষকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করছে।

চাঁদা না দেওয়ায় দোকান ভাঙচুর

ঢাকার ভাটারা থানার চেয়ারম্যানবাড়ির কাছের একটি খোলা স্থানে বসবাস করেন স্থানীয় চা বিক্রেতা মাকসুদা বেগম (৫০)। তাঁর স্বামী নেই। তিনি সেখানে তার অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে বসবাস করেন।

চায়ের দোকান চালিয়ে তিনি তাঁর সন্তানদের লেখাপড়া চালান বলে মামলার এজাহারে বলা হয়েছে।

বাদী মাকসুদার আইনজীবী মাহবুব রানা বেনারকে বলেন, গত ৩০ মে ভাটারা থানা-পুলিশের এসআই হাসান মাসুদ, আরেকজন এসআই (যার নেমপ্লেট ছিল না), কনস্টেবল জাকির ও এক আনসার সদস্যসহ চারজন মাকসুদা বেগমের কাছে মে মাসের মাসোহারা বাবদ ছয় হাজার টাকা ও ঈদ বোনাস বাবদ আরও চার হাজার, মোট ১০ হাজার টাকা দাবি করেন।

তিনি বলেন, মাকসুদা তাঁদের বলেন, রমজান মাসে তাঁর বেচাকেনা কম। তাই এ মাসের টাকা দিতে পারব না।

বাদীর মতে, এরপর ওই চারজন মাকসুদার দোকান ভাঙচুর করেন। এরপর টাকা না দিলে দোকান থাকবে না ও তাঁকে মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে ‘ক্রস ফায়ারে’ দেওয়া হবে বলে হুমকি দেন।

তাঁদের বাদানুবাদের মধ্যে দৈনিক পুনরুদ্ধার নামক সংবাদপত্রের সাংবাদিক বাবুল ইসলাম রাজু দোকান ভাঙচুরের প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, “আপনারা কেন গরিব মানুষের কাছে জোর করে টাকা আদায় করছেন?”

এরপর পুলিশ ও আনসার সদস্যরা রাজুর কলার ধরে মারধর করতে থাকেন। আশপাশের মানুষ জড়ো হয়ে পুলিশদের আচরণের প্রতিবাদ করতে থাকলে তাঁরা পালিয়ে যান।

মাকসুদা বেগম, সাংবাদিক রাজু ও এলাকাবাসীরা ভাটার থানায় গিয়ে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে তাঁদের থানাতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে জানান আইনজীবী রানা।

“তাই বাধ্য হয়ে আমার মক্কেল আদালতে মামলা করেছেন,” বলেন রানা।

পুলিশের অস্বীকার

ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) মাহফুজুর রহমান বেনারকে জানান, আদালতের আদেশ এখনো তাঁদের হাতে পৌঁছেনি। তিনি বলেন, “আমাদের কাছে আদালতের আদেশ পৌঁছালে আমরা নির্দেশ মোতাবেক তদন্ত করে আদালতে উপস্থাপন করব।”

মাহফুজুর রহমান বলেন, “আমাদের সাব-ইন্সপেক্টর হাসান মাসুদ খুব ভালো অফিসার। তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ সত্য নয়। আমরা মানুষের কথা শুনিনি বা থানায় ঢুকতে দেইনি কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি থানায় ১৮ ঘণ্টা কাটাই। সুতরাং, আমাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পুর্ণ মিথ্যা।”

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “যেভাবে মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে তাতে ক্ষমতার অপব্যবহার হতে বাধ্য। সেকারণেই আমরা দেখছি পুলিশের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, এর অর্থ হলো পুলিশ তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা নিচ্ছে না। তিনি বলেন, পুলিশসহ সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জবাবদিহি প্রয়োজন।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, মাদক বিরোধী অভিযানের নামে কোনো নিরীহ মানুষকে হয়রানি করার অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মঙ্গলবার গুলিস্তানে ঈদ উপলক্ষে দুস্থদের মাঝে কাপড় বিতরণের পর সময় এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

তবে পুলিশ কমিশনার জানান, চলমান মাদক বিরোধী অভিযান চলবে। তিনি আরও বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা যত শক্তিশালী হোক না কেন তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে।

“আমরা যেভাবে জঙ্গিদের দমন করেছি সেভাবে মাদক ব্যবসায়ীদের দমন করা হবে,” জানান আছাদুজ্জামান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।