দেশে বন্দিদের প্রায় অর্ধেক মাদক মামলার আসামি
2018.06.22
ঢাকা
চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে ব্যাপক গ্রেপ্তারের ফলে দেশের জেলখানাগুলোতে আর বাড়তি কোনো বন্দি রাখার মতো অবস্থা নেই। তারপরও সারাদেশে প্রতিদিন গ্রেপ্তার হচ্ছে শত শত মানুষ।
এ অভিযান চলতে থাকলে বাড়তি আসামিদের কোথায় রাখা হবে সে ব্যাপারে চিন্তিত কারা কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাঁরা।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেছেন, মাদক বিরোধী অভিযান চলবে। জেলখানায় স্থান সংকুলান না হলেও এই অভিযান চলবে।
দেশের ৬৮ জেলখানার বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৩৬ হাজারের বিপরীতে বর্তমানে রয়েছে প্রায় ৮০ হাজার বন্দি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারাদেশে জেলগুলোতে আটক ৮০ হাজার বন্দির মধ্যে মাদক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মামলায় আটক রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, “আপনার তথ্য ঠিক আছে। আজ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার মাদক মামলার আসামি আটক রয়েছে। দেশের সকল জেলখানার ৪৩ ভাগের বেশি বন্দি এখন মাদক মামলায় আটক।”
তিনি বলেন, “জেলখানায় জায়গা হচ্ছে না এ জন্য কি আমরা অভিযান বন্ধ করে দেবো? না। এটা চলবে। প্রয়োজনে মাদক মামলায় আটক সকল বন্দিকে জেলখানার এক জায়গায় গাদাগাদি করে রাখা হবে। সেখানে থাকুক কয়েক মাস। তাহলে কষ্টে ভবিষ্যতে আর মাদক ব্যবসায় আসবে না।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “অবৈধ মাদক ব্যবসা হলো জঙ্গিবাদসহ অনেক অপরাধের অর্থের উৎস। এটি বন্ধ করা গেলে দেশের অপরাধ অনেকাংশে কমে যাবে।”
গত ১৪ মে শুরু হওয়া মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযানে সারা দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ২৪ হাজার মানুষ আটক হয়েছে। পুলিশ ও র্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে কমপক্ষে ১৫০ জন।
শুক্রবার প্রথম প্রহরে ময়মনসিংহ জেলায় পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুজন অভিযুক্ত মাদক কারবারি নিহত হয়েছে।
হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামী তারাকান্দা উপজেলার কানিহারি গ্রামের শাহেদ আলীর ছেলে আলী হোসেন (৩৮) ও ত্রিশাল উপজেলার ধানিখোলা গ্রামের আবদুল কুদ্দুসের ছেলে স্বপন উদ্দিন (৩৫) পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা শুক্রবার বেনারকে বলেন, “চলমান মাদক বিরোধী অভিযানে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ২৪ হাজার মানুষ আটক হয়েছেন।”
মানবাধিকার লঙ্ঘিত, রোগের ঝুঁকি
কারা অধিদপ্তরের সাবেক উপ-মহাপরিদর্শক অবসরপ্রাপ্ত মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, “আমাদের ৬৮টি কারাগারের বন্দি ধারণ ক্ষমতা এখন প্রায় ৩৬ হাজার। জেলকোড অনুযায়ী একজন বন্দির জন্য ছয় বর্গফুট অর্থাৎ ছয় ফুট দৈর্ঘ্য ও ছয় ফুট প্রস্থের স্থান দরকার। ভালো ব্যবস্থাপনা থাকলে এই ছয় ফুটের মধ্যে আরেকজন বন্দিকে সংকুলান করা যায়।”
তিনি বলেন, “বর্তমানে আমাদের জেলখানায় ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি বন্দি রয়েছে। এ অবস্থায় কোনো কোনো কারাগারের অবস্থা খুব খারাপ। আবার ভালো ব্যবস্থাপনার কারণে কিছু কারাগার অনেক ভালো।”
তাঁর মতে, “বন্দি সংখ্যা বেশি হলে স্থান সংকুলানের চেয়ে অন্যান্য সমস্যা বেশি হয়।”
মেজর হায়দার বলেন, “সবচে বেশি সমস্যা হয় টয়লেট ও গোসলখানার। বন্দি সংখ্যা বেশি হলে টয়লেট ব্যবহার নিয়ে শুরু হয় ‘ম্যানেজ’ করা। যারা ‘ম্যানেজ’ করতে পারে তারা টয়লেটে আগে যায়। আর যারা পারে না তারা যত প্রয়োজন হোক টয়লেট ব্যবহারের সুযোগ পায় না।”
তিনি বলেন, “গাদাগাদি করে বন্দিদের রাখলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়া ছাড়াও রোগ-বালাইয়ের ঝুঁকি বাড়ে। কারণ, কোনো বন্দির যক্ষা বা অন্যান্য ছোঁয়াচে রোগ থাকলে অন্যদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা থাকে।”
কারাগারের বন্দিদের মধ্যে চর্ম রোগ দেখা যায়। বন্দির সংখ্যা বেশি হলে সমস্যা জটিল হয়। কারণ সবসময় পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা যায় না।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, পুলিশ চলমান মাদক বিরোধী অভিযানের প্রতিদিন শতশত মানুষকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠাচ্ছে। আর আদালত জামিন না দিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে।
“কিন্তু এই মানুষগুলোকে কোথায় রাখা হবে সে ব্যাপারে খুব বেশি চিন্তা ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আমাদের অবস্থা খুবই নাজুক,” বলেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, “গতকাল সন্ধ্যায় কারাগারগুলোর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। আমার জানি না সরকারের উচ্চ মহল থেকে এব্যাপারে কী চিন্তা ভাবনা চলছে।”
তিনি বলেন, “কারাগার শাস্তির জায়গা নয়; সংশোধনের জায়গা। কারাগারে সমস্যা থাকলে অপরাধীদের সংশোধনীর আগ্রহ থাকে না।”
মাদক মামলায় আটকের পর দুই বছর জেল খেটেছেন মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার মে. হেলাল। তিনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রিকশা চালান।
তিনি বেনারকে বলেন, “পুলিশের এক দালাল আমার পকেটে ইয়াবা রেখে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়। পুলিশ আমাকে পরদিন কোর্টে তুললে কোর্ট জামিন না দিয়ে জেলে পাঠায়। এর আগে আমি জীবনে কোনোদিন জেল দেখিনি। একটা ১০ ফুট ঘরের মধ্যে ৩৫ জন আসামী গাদাগাদি করে থাকতে হয়।”
হেলাল বলেন, “কোনোভাবে ডান হাত বালিশ বানিয়ে এক কাত হয়ে রাত কাটিয়েছি মাসের পর মাস।”
“ভোর বেলা থেকে টয়লেট ব্যবহার করার জন্য লম্বা লাইন। জেলে টাকা ছাড়া কোনো কথা নেই। টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়। টাকা না দিলে যত জরুরি হোক না কেন পায়খানায় যেতে পারবে না। টয়লেট যাওয়া নিয়ে মারামারি নিত্যদিনের ঘটনা,” বলেন হেলাল।
তিনি বলেন, “জেলখানা থেকে বেরিয়ে আমি যখন প্রথম পায়খানায় যাই সেখানে প্রায় দুই ঘন্টা কাটিয়েছি।”