মেজর সিনহা হত্যা: ওসি প্রদীপসহ তিন পুলিশ সাত দিনের রিমান্ডে
2020.08.06
কক্সবাজার ও ঢাকা

সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মো. রাশেদকে গুলি করে হত্যার দায়ে দায়ের করা মামলার মূল আসামি পুলিশের এসআই মো. লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ অভিযুক্ত নয় জনের মধ্যে সাতজন বৃহস্পতিবার কক্সবাজার আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। দুজন এখনও পলাতক।
তাঁরা বৃহস্পতিবার বিকালে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হেলাল উদ্দিনের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন বলে বেনারকে জানান বাদী পক্ষের আইনজীবী মো. মোস্তফা।
তিনি জানান, অভিযুক্তদের মধ্যে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই মো. লিয়াকত ও এসআই নন্দলালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে বাকিদের জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন আদালত।
র্যাবের পক্ষ থেকে আসামিদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছিল।
মামলার অপর দুই আসামি এসআই মো. টুটুল ও কনেস্টবল মোস্তফা আদালতে আত্মসমর্পন করেননি বলে জানান মো. মোস্তফা।
মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর সেনা ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সৃষ্ট মতবিরোধ নিরসনে বুধবার সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ এবং পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ কক্সবাজারে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করার পরদিনই অভিযুক্তরা আদালতে আত্মসমর্পণ করলেন।
ওই সংবাদ সম্মেলনে দুই বাহিনী প্রধান জানান, মেজর সিনহাকে হত্যার দায়-দায়িত্ব ব্যক্তির, প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুলিশের নয়। যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন তাঁরা এর প্রায়শ্চিত্ত করবেন বলে জানান সেনাপ্রধান।
বুধবারই কক্সবাজারে টেকনাফ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ্’র আদালতে ওসি প্রদীপ ও মো. লিয়াকতসহ নয়জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস।
মামলাটি আমলে নিয়ে ১৫ র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ান (র্যাব) কে তদন্তের নির্দেশ দেন বিচারক।
আদালতের আদেশ অনুযায়ী, দায়েরকৃত মামলাটি বুধবার রাতেই টেকনাফ মডেল থানায় নিয়মিত একটি হত্যা মামলা হিসাবে রুজু করা হয়।
এছাড়া, মামলায় এজাহারভুক্ত নয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়।
অভিযুক্তরা হলেন, এসআই লিয়াকত, ওসি প্রদীপ, এসআই নন্দলাল রক্ষিত, এসআই টুটুল, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন ও কনস্টেবল মোঃ মোস্তফা।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরদিন বৃহস্পতিবার ওসি প্রদীপ চট্টগ্রামে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছা জানান। এরপর তাঁকে কক্সবাজার আদালতে হাজির করে পুলিশ।
এ মামলায় নিহত সেনা কর্মকর্তা সিনহার সঙ্গী ও ৩১ জুলাই এর ঘটনায় টেকনাফ পুলিশের দায়ের করা মামলার আসামি সাহেদুল ইসলাম সিফাতসহ ১০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
পুলিশের হাতে আটক সিফাত ও আরেক ছাত্রীর মুক্তির দাবিতে বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ করেছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার ফেরার পথে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা।
পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তল্লাশি কাজে সহয়তা না করে পিস্তল বের করে গুলি চালাতে চেয়েছিলেন মেজর সিনহা। আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালায় বলে জানানো হয়।
অন্য দিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, হাত উপরে তুলে গাড়ি থেকে নামেন মেজর সিনহা। তারপরও তাঁকে গুলি করেন পুলিশের এসআই লিয়াকত।
এই ঘটনা তদন্ত করতে একজন যুগ্ম সচিবেবর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার কাজ শুরু করে তদন্ত কমিটি।
তদন্ত দলের সদস্যরা বৃহস্পতিবার টেকনাফ থানায় কয়েকজন পুলিশ সদস্যর সঙ্গে কথা বলে মামলার আলামত সংগ্রহ করেছেন বলে জানিয়েছেন টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবিএমএস দোহা।
তিনি জানান, তদন্ত দল সিনহার মৃত্যুর ঘটনাস্থল বাহারছড়াও পরিদর্শন করেন।
তবে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি তদন্তদলের কোনো সদস্য। আগামী সাতদিনের মধ্যে তদন্ত দলের প্রতিবেদন জমা দেবার কথা রয়েছে।
মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার ঘটনাকে “ভালো উদ্যোগ,” বলে মন্তব্য করেন মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান।
তবে টেকনাফ এলাকায় ২০১৮ সালের মে মাস থেকে বর্তমান পর্যন্ত “প্রায় ২০০ মানুষকে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “দুঃখের ব্যাপার হলো, অন্য কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে কোনো পুলিশ-র্যাব সদস্যের বিচার শুরু হয়নি।”
“এর অর্থ হলো রাষ্ট্র বাংলাদেশ ক্ষমতাহীন দরিদ্র মানুষের জীবনের মূল্য দেয় না,” বলেন নূর খান।
তবে মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের বিচার করা গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে “কিছুটা হলেও ভয় কাজ করবে,” বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান।
“ফলে হয়ত, আগামীতে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কিছুটা হলেও কমবে,” বেনারকে বলেন তিনি।
টেকনাফে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যৌথ টহল
বৃহস্পতিবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যার ঘটনাকে ‘অনাকাঙ্খিত’ বলে উল্লেখ করে বলা হয়, টেকনাফ এলাকায় পুলিশ ও সেনাবাহিনী যৌথ টহল দেবে।
“আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে এবং এলাকার মানুষের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনতে” এই যৌথ টহল প্রসঙ্গে সেনাপ্রধান ও পুলিশ প্রধান “উভয়ই সম্মত হয়ে” নিজ নিজ বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
টেকনাফ থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আবদুর রহমান।