ছিটমহল বিলুপ্তির ২ বছর: ভারতে হতাশা, ভিন্ন চিত্র বাংলাদেশে
2017.08.01
কলকাতা ও ঢাকা

দুই বছরেও স্থায়ী পুনর্বাসন ব্যবস্থা না করার প্রতিবাদে ছিটমহল বিনিময় দিবসের অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন ভারতের কোচ বিহারের তিনটি অস্থায়ী শিবিরে বসবাসকারী সাবেক ছিটের বাসিন্দারা।
নানা বঞ্চনা আর হতাশা নিয়ে ভারতে বসবাসকারী এসব সাবেক ছিটবাসীদের দিন কাটলেও বাংলাদেশের মূলধারায় মিশে যাওয়া সাবেক ছিটবাসীরা নানা আয়োজনে উযদযাপন করছেন ‘স্বাধীনতা’ পাওয়ার দুই বছর।
“স্বাধীনভাবে বসবাসের আশা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে পরিবার নিয়ে ভারতে এসেছিলাম। কিন্তু দুই বছরেও আমাদের বাড়ি নেই, জমি নেই। কাজও নেই,” বেনারকে বলেন কোচ বিহারের মেখলিগঞ্জ অস্থায়ী শিবিরের বাসিন্দা বিনোদ বর্মন।
তবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “রাস্তাঘাটসহ উন্নয়নের নানা কাজ চলছে। স্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য বাড়িও তৈরি হচ্ছে।”
প্রায় ৬৮ বছর ধরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের ভূখণ্ডে ও ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ছিল। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই ১৬২টি ছিটমহল দুই দেশের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে মিশে যায়।
২০১০ সালের যৌথ জনগণনা অনুযায়ী দুদেশের ১৬২টি ছিটমহলের মোট জনসংখ্যা ছিল ৫১ হাজার ৫৪৯ জন। এর মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১১১টি ছিটমহলে জনসংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলে ১৪ হাজার ২১৫ জন।
ছিটমহল বিনিময়ের সময় ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ছিটের কোনো বাসিন্দা বাংলাদেশে না এলেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল থেকে ৯২১ জন ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।
পরবর্তীতে এই ৯২১জনকে রাখা হয় কোচবিহার জেলার দিনহাটা, মেখলিগঞ্জ ও হলদিবাড়িতে তিনটি অস্থায়ী শিবিরে।
এছাড়া ভারতের অভ্যন্তরের বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে উন্নয়ন কাজ শুরু হলেও তা ব্যাপক নয় বলে জানিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
“এখনো পর্যন্ত এদের জমির স্বত্ব দেওয়া হয়নি। এদের নাগরিকত্ব, তফসিলিপত্র, জন্ম ও মৃত্যুর সনদ দেওয়া নিয়েও সমস্যা রয়েছে,” বেনারকে বলেন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ মাসুমের সম্পাদক কীরিটি রায়।
তিনি জানান, “গত দুই বছরে তিনটি অস্থায়ী ক্যাম্পের প্রায় ১৩-১৪ জন উপযুক্ত চিকিৎসা ও অন্যান্য সহায়তার অভাবে মারা গেছে।”
গত ২৬ জুলাই কোচবিহারের জেলা শাসক কৌশিক সাহার কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে মৌলিক নাগরিক সুবিধা রয়েছে এমন জায়গায় স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা না হলে মেখলিগঞ্জের ভোটবাড়ির অস্থায়ী শিবিরের সাবেক ছিটমহলবাসীরা আরও বড় আন্দোলনে নামতে প্রস্তুত বলে বেনারকে জানান আন্দোলনকারীদের অন্যতম বিপুল চন্দ্র রায়।
তিনি জানান, প্রয়োজনে তাদের সবাইকে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা।
গত ১৪ জুন থেকে ১৭ জুন টানা চার দিন মেখলীগঞ্জ মহকুমা প্রশাসকের অফিসের সামনে তারা একই দাবিতে অনশন কর্মসূচি পালন করেছেন।
নাগরিক অধিকার সমন্বয় কমিটির মুখ্য সমন্বয়কারী দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বেনারকে বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করলেও রাজ্য সরকার দুই বছরে স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারেনি। ফলে সাবেক ছিটবাসীরা অনেকেই বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাইছেন।”
দিনহাটার শিবিরের বাসিন্দা ওসমান গনি বলেন, “খাবার, কাজ, স্বাস্থ্য, পড়াশোনা কোনো পরিসেবাই ঠিকমতো পাই না। প্রশাসনের দেওয়া রেশনে দিন চলা কষ্ট। গরম, শীত কিংবা বর্ষায় এই অস্থায়ী টিনের ঘরে বসবাস করাও কষ্টকর। রয়েছে নিরাপত্তার অভাবও।”
“ভারতে এসে এই অবস্থা হবে জানলে নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশেই থেকে যেতাম,” বলেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে হরিয়ানায় কাজ করতে গিয়ে কারান্তরালে দিন কাটাচ্ছেন রফিকুল। তাঁর ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে আদালত।
রফিকুলের মা রহিমা বিবি বেনারকে বলেন, “জামিনের শর্ত হিসেবে তিনজন নিকট আত্মীয়ের জমির নথি দেখাতে বলা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আসার পরে আমরা কেউই এখনো ভারতে জমির নথি পাইনি।”
এ প্রসঙ্গে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বেনারকে বলেন, “জমির কাগজ হাতে পাওয়া সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে কী করে আইনি জটিলতা কাটিয়ে রফিকুলকে মুক্ত করা যায় তার চেষ্টা চলছে।”
এদিকে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বিলুপ্ত বাংলাদেশি ছিটমহলের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বাসিন্দারা গত দু বছরে রেশন কার্ড ও ভোটার পরিচয়পত্রের মতো নাগরিক সনদ পেলেও এখন পর্যন্ত তারাও জমির কোনো সত্ত্ব পাননি।
“ভারতে থাকা সাবেক বাংলাদেশিরা জমিতে বসবাস করলেও আইনিভাবে তাদের জমির মালিকানা দেওয় হয়নি,” বেনারকে জানান মধ্য মশালডাঙ্গার বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন।
বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ১১১টি ছিটমহলের ১২টি কুড়িগ্রামে, ৫৯টি লালমনিরহাটে, ৩৬টি পঞ্চগড়ে এবং ৪টি নীলফামারী জেলায় পড়েছে। এসব এলাকায় মাত্র দুই বছরের মধ্যেই ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। একসময়ের বঞ্চিত জনপদের ঘরে ঘরে এখন বিদ্যুতের আলো। ছেলেমেয়েরা ফিরে পেয়েছে শিক্ষার অধিকার। স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি বিলুপ্ত ছিটবাসীর জন্য রয়েছে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা। নিজেদের জমির কাগজপত্রও বুঝে পাচ্ছে তাঁরা। রয়েছে ডিজিটাল তথ্যসেবা কেন্দ্রের সেবাও।
বিলুপ্ত বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির লালমনিরহাট জেলা সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলে, “ছিটের গরিবদের জন্য বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফসহ বিভিন্ন কার্ডের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মাত্র ২ বছরে আমাদের ভাগ্যোন্নয়নে সরকারের যে আন্তরিকতা দেখিয়েছে, তাতে আমরা কৃতজ্ঞ।”
পতাকা উত্তোলন, মোমবাতি প্রজ্বলন, খেলা-ধুলাসহ নানা আয়োজনে ‘স্বাধীনতার’ দুই বছর পূর্তিতে প্রতিটি ছিটমহলে বিজয় উৎসব পালন হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তবে নীলফামারীর বিলুপ্ত ছিটমহল ২৯ নম্বর বড়খানকি খারিজা গিদালদহ গ্রামের বাসিন্দা মো. শফিকুজ্জামান জানান বলেন, “সরকার অনেক কিছুই দিয়েছে। তবে এখনো ছিটের রাস্তা ঠিক করেনি। আশা করি দ্রুত এই সমস্যাও মিটে যাবে।”
“সবচেয়ে বড় ছিটমহল দাসিয়ার ছড়ার উন্নয়নে ৮৫ কোটি টাকার উন্নয়ন অনুমোদন দেয় সরকার। সেই প্যাকেজের উন্নয়নকাজ শেষের পথে। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন বিভাগ এই এলাকার উন্নয়নকাজ অব্যাহত রেখেছে,” বেনারকে জানান ফুলবাড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবেন্দ্রনাথ উরাঁও।