মাদক চোরাচালান বন্ধে যৌথভাবে কাজ করার ঘোষণা বাংলাদেশ ও ভারতের

কামরান রেজা চৌধুরী ও পরিতোষ পাল
2019.08.08
ঢাকা ও কলকাতা
190808_India_bangladesh_1000.jpeg নয়াদিল্লিতে দুদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের শুরুতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি চিত্রকর্ম উপহার দেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ৭ আগস্ট ২০১৯।
[সৌজন্যে: বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়]

ইয়াবাসহ সকল প্রকার মাদকদ্রব্যের চোরাচালান বন্ধে যৌথভাবে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সপ্তম সভায় এই ঘোষণা দেয়া হয়।

“সভায় মাদক পাচার ও চোরাচালান প্রতিরোধে উভয় দেশ যৌথভাবে কাজ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে,” বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

এতে আরো বলা হয়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হয়েছে।

দুদেশের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবা নির্মূলে কক্সবাজারের টেকনাফকেন্দ্রিক চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করেছে। এতে চোরাকারবারীরা ইয়াবা পাচারের রুট পরিবর্তন করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা পাচার করছে। দুপক্ষই মনে করছে ভারতের বিএসএফ এবং বাংলাদেশের বিজিবি একসাথে কাজ করলে ইয়াবা পাচার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।

বৃহস্পতিবার দিল্লি থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, “সীমান্তকে বন্ধুত্বপূর্ণ রাখার অঙ্গীকারের কথা পুর্নব্যক্ত করার পাশাপাশি দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার প্রশংসা করা হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সহযোগিতার সব দিক নিয়েই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় আলোচনা করেছেন।”

এতে আরো বলা হয়, নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুই দেশ আগের চেয়ে বেশি ঘনিষ্টভাবে কাজ করায় দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করেন।

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং ভারতীয় দলের নেতৃত্ব দেন সেদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীনান্তের অদূরে অবস্থিত মিয়ানমার-চীন সীমান্তে চীন ও কোচিন রাজ্যে ইয়াবা তৈরির কারখানাগুলো অবস্থিত। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য হয়ে ইয়াবা বাংলাদেশে আনা হয়।

২০১৭ সালে মাদকসেবীদের ওপর পরিচালিত সরকারি জরিপ অনুযায়ী, দেশে ব্যবহৃত মাদকদ্রব্যের শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ ইয়াবা। আর মাদকসেবীদের শতকরা ৭৫ ভাগ যুবক। মাত্র সাত ভাগের বেশি মাদকসেবীর বয়স ৪০ বছরের ওপরে।

একই জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে মাদক প্রবেশ করে।

ইয়াবার উৎপাদন ও চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বেশ কয়েকবার আলোচনা হয়েছে। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সেগুলো বন্ধ করার আশ্বাস দেয়া হলেও ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ হয়নি।

গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেছিলেন, “ইয়াবা আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এজন্য আমরা ইয়াবাসহ সব মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। এই যুদ্ধ চলবে।”

তিনি বলেন, “ইয়াবা বন্ধে আমরা মিয়ানমার সরকারের সাথে বহুবার আলোচনা করেছি। তারা অতীতে বহুবার ইয়াবা বন্ধে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছে। কার্যত বাংলাদেশে ইয়াবা আসা বন্ধ হয়নি।”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান শুরুর পর থেকে টেকনাফ এখন আর ইয়াবা চালানের বড় রুট নয়। পাচারকারীরা এখন অন্যান্য রুট দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা আনছে।”

তাঁর মতে, “ইয়াবা বন্ধে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ, বাংলাদেশে কোনো মাদক উৎপাদন হয় না।”

মন্ত্রী বলেন, “বন্ধু রাষ্ট্র ভারত ফেনসিডিল নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক নির্মূলেও তারা সহায়তা করবে।”

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকার কর্মী নূর খান বেনারকে বলেন, “বর্তমান সরকার গত বছরের মে মাস থেকে মাদক বিরোধী অভিযান করেছে। এসময় মাদক চোরাচালানের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযুক্ত প্রায় চারশ’ মানুষ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, মাদক চোরাকারবারীরা নিজেদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “এগুলো আসলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। বিশেষ করে টেকনাফে কাউন্সিলর একরাম হত্যাকাণ্ডের পর দেশের মানুষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ব্যাপারে সংশয় তৈরি হয়েছে।”

নূর খান বলেন, “মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবে প্রায় ১৮ হাজারের মতো মানুষ মাদক কারবারের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ইয়াবা এখন প্রধান মাদকদ্রব্য। এর উৎপাদন হয় মিয়ানমারে এবং এর পাচারের প্রধান রুট ছিল কক্সবাজার জেলার টেকনাফ। পাচারকারীরা টেকনাফ রুট পরিবর্তন করে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবার চালান পাঠায়।”

তাঁর মতে, “বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী একসাথে কাজ করলে সীমান্তে দিয়ে ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদকদ্রব্য প্রবেশ বন্ধ হবে।”

নূর খান বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারত খোলা মনে আন্তরিকতার সাথে একসাথে কাজ করলে ইয়াবা সমস্যার সমাধান হবে। তবে মাদক ব্যবসায়ীরা পাচারের কাজে প্রচুর অর্থ লগ্নি করে। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী এই অর্থের লোভ কতটুকু সংবরণ করতে পারবে সে ব্যাপারে সংশয় রয়েছে।”

রোহিঙ্গা প্রত্যাবসানে সহযোগিতার আশ্বাস

দুই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে গুরুত্ব পায় মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়টি।

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, “ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমার নাগরিকদেরকে নিরাপদে ও দ্রুত স্বদেশ প্রত্যাবসানে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।”

বৈঠক প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী কলকাতায় বেনারকে বলেন, “ভারত বাংলাদেশের পাশেই রয়েছে। চার দফায় মানবিক সাহায্যও পাঠিয়েছে। কৌশলগতভাবেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক উল্লেখ করে দ্রুত প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পাশে থাকার বার্তা দেবার পেছনে ভারতের নিজেরও স্বার্থ রয়েছে।”

তাঁর মতে, “বাংলাদেশে যে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তারা সুযোগ বুঝে ভারতেও ঢুকে পড়তে পারে। তাই দ্রুত প্রত্যাবাসনে বা ফেরত পাঠানোর উদ্যোগে ভারত সবসময়ই সহায়তা করে যাবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।