বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে সময়ের বাধ্যবাধকতায় নারী অধিকার কর্মীদের ক্ষোভ
2018.04.12
ঢাকা
পয়লা বৈশাখ বিকেল ৫টার মধ্যে উন্মুক্ত জায়গায় বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শেষ করতে সরকারের নির্দেশনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নারী অধিকার সংগঠনের নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মীরা। এই নির্দেশনার মাধ্যমে রক্ষণশীল, সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে রাষ্ট্র নতি স্বীকার করছে বলে মনে করেন তাঁরা।
বিষয়টি অত্যন্ত লজ্জার উল্লেখ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান শেষ করার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে কয়েকটি নারী সংগঠনের মোর্চা নারী নিরাপত্তা জোট এক সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি জানায়।
সেখানে নারী নিরাপত্তা জোটের আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন, “আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নাগরিকদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে। কে, কখন ঘরে থাকবে আর কখন বাইরে থাকবে তা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ব্যাপার। ব্যক্তি নিজেই সে সিদ্ধান্ত নিবেন।”
“কিন্তু সময় বেঁধে দেওয়ার মাধ্যমে রক্ষণশীল, সাম্প্রদায়িক, উৎসব বিরোধী, নারী অধিকার বিরোধী শক্তির কাছে রাষ্ট্র নতি স্বীকার করছে। যা অত্যন্ত লজ্জার বিষয়,” বলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে দেশজুড়ে এবারও উন্মুক্ত স্থানে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেবলমাত্র রাজধানীর রবীন্দ্রসরোবরের অনুষ্ঠান চলতে পারবে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। গত ৩ এপ্রিল সচিবালয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা–সংক্রান্ত সভা শেষে এ নির্দেশনা দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
২০১৫ সালের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে যৌন নিপীড়নের ঘটনার পর থেকে প্রতিবছরই বাংলা নববর্ষের সকল অনুষ্ঠান বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করার বাধ্যবাধকতা দিয়ে আসছে সরকার।
সে বছর বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন মানবাধিকারকর্মী, নারী নেত্রী, উন্নয়নকর্মীসহ বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির প্রতিনিধিদের মোর্চা হিসেবে এ নারী নিরাপত্তা জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
‘উল্টো পথে রাষ্ট্র’
প্রতি মুহূর্তেই নারীর জন্য বাইরের জায়গা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা কামাল বলেন, “নারী কোথায় যাবে, কোন পোশাক পরবে তা অন্যদের মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে। বিরোধী শক্তির কাছে রাষ্ট্রও নতি স্বীকার করছে।”
“কেউ চাইলে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান বিকেল পাঁচটার মধ্যে শেষ করতেই পারে। কিন্তু সেটা বলে দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের নয়। উৎসবের মধ্যে বা কর্মক্ষেত্রে যেখানেই থাকুক ২৪ ঘণ্টা নাগরিককে নিরাপত্তা দেওয়াই রাষ্ট্রের দায়িত্ব,” বলেন এই মানবাধিকার কর্মী।
“যে কোনো উৎসবে মুক্তভাবে বিচরণ করার অধিকার সকল নাগরিকেরই আছে। তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অথচ সেটা না করে রাষ্ট্র উৎসবটাই নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। সব দেখে মনে হয় রাষ্ট্র উল্টো দিকে হাঁটছে,” বলছিলেন অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ।
সুলতানা কামাল বলেন, “রাষ্ট্রের ঘোষণা অনুযায়ী, বিকেল পাঁচটার পর যে কেউ যে কোনো কিছু ঘটাতে পারে। কোনো নারী তখন রাস্তায় থাকলে বা কোনো বিপদ হলে রাষ্ট্র তখন তাঁকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না।”
“অর্থাৎ এই সময়ের পরে হয়রানির ঘটনা ঘটলে দায়িত্ব না নেওয়ার ঘোষণার মাধ্যমে সরকার পক্ষান্তরে অপরাধীদের সুযোগ করে দিয়েছে,” বলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার কর্মী খুশি কবীর বেনারকে বলেন, “রাষ্ট্রের এই ঘোষণা নারীর জন্য নিঃসন্দেহে অবমাননাকর। আধুনিক এই যুগে নারীকে এভাবে সময়ের মধ্যে আটকে রাখা সম্ভব নয়। বরং তাঁদের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। সে দায়িত্ব রাষ্ট্র এড়িয়ে যেতে পারে না।”
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর মহুয়া লেয়া ফলিয়া।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমাদের জোটের পক্ষ থেকে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের সময়ের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ার চারটি দাবি জানিয়েছি।”
এ ছাড়া খোলা জায়গা নারী ও পুরুষ সবার জন্য উপযুক্ত করা, নারীদের নিরাপত্তায় বিশেষ নজর দেওয়া এবং যৌন হয়রানির ঘটনায় জড়িতদের বিচার করার দাবিও জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে কোনো জনসমাগম অথবা গণ অনুষ্ঠানে নারীরা বিভিন্নভাবে যৌন হয়রানি, নির্যাতন, নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
নিরাপত্তা হুমকি নেই
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে কোনো নিরাপত্তা হুমকি নেই। তারপরেও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে কোনো নিরাপত্তা হুমকি নেই। সবাই আনন্দ করবে, নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের।”
এদিনের শোভাযাত্রা নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে পরিচালিত হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “শোভাযাত্রায় কেউ মুখোশ ব্যবহার করতে পারবে না। মুখোশ হাতে রাখতে হবে। যাদের হাতে মুখোশ থাকবে, তাঁদের তালিকাও চারুকলা থেকে দেওয়া হবে।”
শোভাযাত্রা শুরুর পর হুট করে কেউ এসে সেখানে যোগ দিতে পারবে না বলেও জানান তিনি।
এ ছাড়া নববর্ষের অনুষ্ঠানে ভুভুজেলা ব্যবহার, যেকোনো ধরনের ভ্যানিটি ব্যাগ, ট্রলি, ব্যাগ, হাতব্যাগ, নেইলকাটার, দাহ্য বস্তু নিয়ে শোভাযাত্রা বা অনুষ্ঠানে ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ডিএমপি।
আছাদুজ্জামান জানান, নববর্ষের অনুষ্ঠানে পুলিশের বিশেষ দল ইভ টিজিং প্রতিরোধে কাজ করবে। এ ছাড়া ছায়ানটের অনুষ্ঠান উপলক্ষে জোরালো নিরাপত্তা দেওয়া হবে।