সাড়ে চার বছর পর ব্লগার নাজিমুদ্দিন সামাদ হত্যার চার্জশিট দিলো পুলিশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.08.20
ঢাকা
200820_Blogger_Nazimuddin_Chargesheet-1000.jpg ব্লগার নাজিম উদ্দিন সামাদ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে ঢাকায় মানববন্ধন। ৮ এপ্রিল ২০১৬।
[এপি]

প্রায় সাড়ে বছর আগে ঢাকার সূত্রাপুর এলাকায় জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে নিহত ব্লগার নাজিম উদ্দিন সামাদ হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র বৃহস্পতিবার আদালতে জমা দিয়েছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিট।

এই হত্যাকাণ্ডের সাথেও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে অধিক পরিচিত জঙ্গি গোষ্ঠী আনসার আল ইসলামের সদস্যরা জড়িত থাকার প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে বলে বেনারকে জানান কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিটের উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “আমরা ব্লগার নাজিম হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।”

সাইফুল ইসলাম বলেন, “এই হত্যাকাণ্ডে মোট নয়জনের সম্পৃক্ততা পেয়েছি। তাঁদের মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা গেছে: রশিদ উন নবী, মোজাম্মেল হোসাইন সায়মন, আরাফাত রহমান ও মোঃ শেখ আব্দুল্লাহ।”

সাইফুল ইসলাম জানান, মামলার অন্যান্য আসামিরা হলেন- চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়া, মোঃ ওয়ালি উল্লাহ ওরফে ওলি, সাব্বিরুল হক চৌধুরী ওরফে কনিক, মওলানা জুনেদ আহম্মেদ ওরফে জুনায়েদ এবং আকরাম হোসেন। তাঁরা পলাতক।

মূলত অনলাইনে ‘ইসলামকে অবমাননা’ করে পোস্ট দেয়ায় সামাদকে জঙ্গিরা খুন করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে সব ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সাথে আনসার আল ইসলামই জড়িত।”

২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল রাতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সান্ধ্যকালীন ছাত্র নাজিম উদ্দিন ক্লাস শেষে গেন্ডারিয়ার মেসে ফেরার পথে লক্ষ্মীবাজারের একরামপুর মোড়ে নিহত হন।

পাঁচ-ছয়জন দুর্বৃত্ত চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে এবং গুলি করে তাঁকে হত্যা করে দুটি মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়। পরদিন সূত্রাপুর থানায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা হয়।

তদন্ত করে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিট।

ঢাকা বারের সদস্য প্রকাশ বিশ্বাস বেনারকে বলেন, ব্লগার নাজিম হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরুর পরবর্তী ধাপে আদালত এখন চার্জশিটের ওপর শুনানির জন্য দিন ধার্য করবেন।

তিনি বলেন, চার্জ গঠনের জন্য আসামিদের উপস্থিতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু পাঁচ আসামি পলাতক সেহেতু তাঁদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পুলিশকে নির্দেশ দেবেন আদালত।

পুলিশ যদি তাঁদের খুঁজে না পায় তখন তাঁরা আদালতকে জানাবে। এরপর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তাঁদের আদালতে হাজির হতে বলা হবে। এরপরও যদি তাঁরা অনুপস্থিত থাকে তখন তাঁদের অনুপস্থিতিতে চার্জগঠন হবে ও বিচারকাজ শুরু হবে।

গণজাগরণ মঞ্চের সাথে সম্পৃক্ত জীবনানন্দ জয়ন্ত বেনারকে বলেন, “অভিজিৎ রায়সহ বাংলাদেশে যত ব্লগার হত্যাকাণ্ডের অথবা হামলার শিকার হয়েছেন তাঁরা সবাই সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য আক্রান্ত হয়েছেন।”

তিনি বলেন, “কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এই হত্যাকাণ্ডগুলোর দ্রুত তদন্ত শেষ করার প্রবণতা আমরা দেখিনি। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত দীর্ঘায়িত হয়েছে। এর ফলে  সমাজে এখন মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। মানুষ কথা বলতে ভয় পায়। আর জঙ্গিরা এমন সমাজই চায় যেখানে কেউ ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলবে না।”

বাংলাদেশে ব্লগার হত্যার বিচার

ধর্ম অবমাননার কারণে ২০১৩ সাল থেকে মুক্তচিন্তার ব্লগার, লেখক, প্রকাশকসহ অন্যান্য গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে হত্যা করা শুরু করে নিষিদ্ধ জঙ্গি গোষ্ঠী আনসার-আল-ইসলাম জঙ্গিরা।

২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মিরপুরে নিজের বাসার কাছে গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা।

ওই ঘটনায় ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দুই জঙ্গির ফাঁসি, একজনের যাবজ্জীবন, তিনজনের ১০ বছর কারাদণ্ড, একজনের পাঁচ বছর ও একজনের তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরের কাছে ব্লগার, বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গিরা। তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হন।

চার বছরের বেশি সময় ধরে তদন্ত চলার পর ২০১৯ সালে আদালতে চার্জশিট জমা দেয় কাউন্টার টেররিজম অ্যাণ্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমস ইউনিট।

২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল চার্জশিট গ্রহণ করে পাঁচ জঙ্গির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী আদালত। এই বিচার এখনও চলছে।

২০১৫ সালের ৩০ মার্চ তেজগাঁও এলাকায় অভিজিৎ রায়ের মতো একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ওয়াশিকুর রহমান বাবু নামের আরেক ব্লগারকে।

২০১৬ সালের ২০ জুলাই এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়। এই হত্যাকাণ্ডে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা জড়িত বলে পুলিশি প্রতিবেদনে জানান হয়।

২০১৫ সালের ১২ মে সিলেটে খুন হন ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস। চার বছর পর ২০১৯ সালের ৮ মে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়।

২০১৫ সালের ৭ আগস্ট ঢাকা গোড়ান এলাকায় নিজ বাসায় ব্লগার নীলয় চক্রবর্তী ওরফে নীলকে হত্যা করে জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা। তবে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এখনও শেষ হয়নি।

২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগে জাগৃতি প্রকাশনের কার্যালয়ে জবাই করে হত্যা করা হয় অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে। তিন বছর পর ১৩ অক্টোবর দীপন হত্যার বিচার শুরু হয়।

এই হত্যাকাণ্ডেও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যরা জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।