ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ড: রায়ের দিনই পুনরায় অভিযোগ গঠনের আদেশ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.10.27
ঢাকা
201027_Washiqur_Babu_Murder_Trial_1000.JPG নিজের ফোনে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডের রায় সম্পর্কিত সংবাদ পড়ছেন ঢাকার একজন পাঠক। ২৭ অক্টোবর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রায় ঘোষণার দিন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ পুনরায় গঠনের আদেশ দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত।

এর ফলে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার তারিখ থাকলেও মঙ্গলবার তা স্থগিত করা হয়।

আগামী ৪ নভেম্বর আবার ওই পাঁচ সন্দেহভাজন জঙ্গির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ।

আইন পেশায় নিযুক্তরা বলছেন, রায়ের আগ মুহূর্তে ফের অভিযোগ গঠনের আদেশ আইনসিদ্ধ। তবে তা সচরাচর ঘটে না।

“অভিযোগ গঠনের সময় মামলার তিন নম্বর আসামি সাইফুল ইসলাম ওরফে মানসুরের অপরাধ উল্লেখ করা হয়নি,” বলে বেনারকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সালাউদ্দিন হাওলাদার।

তিনি বলেন, “সাইফুল ঘটনার সময় অন্য মামলায় কারাগারে ছিল। তার নাম এসেছে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে। সুতরাং, আজ যদি রায় হতো তাহলে সাইফুল খালাস পেত। কারণ যে কারাগারে ছিল তাকে তো আর হত্যার দায়ে সাজা দেয়া যায় না। তাই ওই চার্জ গঠন ছিল ত্রুটিপূর্ণ।”

২০১৫ সালের ৩০ মার্চ ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করে পালানোর সময় জনতার হাতে ধরা পড়েন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের দুই সদস্য জিকরুল্লাহ ওরফে হাসান ও আরিফুল ইসলাম ওরফে মুশফিক ওরফে এরফান।

বাবুর বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ ছিল, তিনি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে ব্লগে লেখালেখি করতেন।

তদন্তে হাতেনাতে ধরা পড়া দুই জনসহ মোট পাঁচজনের সংশ্লিষ্টতা পায় পুলিশ। এরা সবাই আনসার আল ইসলামের সদস্য। তাঁরা হলেন: জিকরুল্লাহ ওরফে হাসান, আরিফুল ইসলাম ওরফে মুশফিক ওরফে এরফান, সাইফুল ইসলাম ওরফে মানসুর, মাওলানা জুনায়েদ আহম্মেদ ওরফে তাহের ও সাইফুল ইসলাম ওরফে আকরা।

ওই পাঁচজনের মধ্যে মাওলানা জুনায়েদ আহম্মেদ ওরফে তাহের ও সাইফুল ইসলাম ওরফে আকরা পলাতক। তাঁদের পলাতক দেখিয়েই মামলার বিচারিক কার্যক্রম চলে। বাকি তিনজন কারাগারে।

মামলার তিন নম্বর আসামি সাইফুল ইসলাম ঘটনার সাতদিন আগে আরেকটি মামলায় আটক হয়ে কারাগারে ছিলেন।

আদালতে জমা দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ জানায়, সাইফুল ইসলাম ওরফে মানসুর এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য চক্রান্ত করেন যা দণ্ড আইনের ১২০(বি) ধারা মোতাবেক অপরাধ।

সাইফুল হত্যার চক্রান্ত করার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন বলেও জানায় পুলিশ।

তবে ২০১৬ সালের ২০ জুলাই অভিযোগ গঠনের সময় ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে সাইফুল ইসলাম ওরফে মানসুরের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ।

তিনি বলেন, মোট ৪০ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৪ জনের সাক্ষ্য শেষে গত ৪ অক্টোবর বিচারকাজ শেষ করে ২৭ অক্টোবর রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করেন বর্তমান বিচারক রবিউল ইসলাম। আদালত আমাদের আবেদন গ্রহণ করে আগামী ৪ নভেম্বর নতুন করে অভিযোগ গঠনের তারিখ নির্ধারণ করেছেন।”

রায় ঘোষণার জন্য মঙ্গলবার আদালতে উপস্থিত করা হয় আটক তিন আনসার আল ইসলাম সদস্যকে। গত ১০ সেপ্টেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন ওই তিন আসামি।

রায় ঘোষণার আগ মুহূর্তে পুনরায় অভিযোগ গঠনের ঘটনা খুব একটা না ঘটলেও বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী রায় ঘোষণার আগে যে কোনো মুহূর্তে বিচারক বিচার কার্যক্রম আবার শুরু করার আদেশ দিতে পারেন বলে বেনারকে জানান সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ।

“এই ব্যবস্থা রাখার কারণ হলো, বিচার যেন সঠিক হয়। তাই আজ ব্লগার ওয়াশিকুর হত্যাকাণ্ডের বিচারের আবার চার্জ গঠনে কোনো সমস্যা দেখি না। তবে এ কারণে বিচার প্রক্রিয়া কিছুটা বিলম্বিত হলো মাত্র,” বলেন ব্যারিষ্টার শফিক।

তিনি বলেন, “যেহেতু পুলিশি তদন্তে বলা হয়েছে সাইফুল ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যার চক্রান্ত করেছে, তাই চার্জ গঠনের সময় বিচারকের উচিত ছিল তার বিরুদ্ধে চক্রান্তের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ গঠন করা। তিনি বিষয়টি উল্লেখ না করায় সাইফুলের ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।”

তিনি বলেন, “আমার মনে হয় চার্জ গঠনের সময় বিচারকের আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। যদি প্রসিকিউসন খেয়াল না করত তাহলে সাইফুল ছাড়া পেয়ে যেত। যদি সে বেকসুর খালাস পেত তাহলে জঙ্গিদের বিচারে একটি খারাপ নজির স্থাপিত হতো।”

বাংলাদেশে ব্লগার হত্যাকাণ্ড

তেজগাঁও কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে ওয়াশিকুর রহমান বাবু (২৭) মতিঝিলের ফারইস্ট এভিয়েশন নামের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন।

তাঁর গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর। তাঁর বাবার নাম টিপু সুলতান।

জনপ্রিয় সামহোয়্যারইন ব্লগে ‘বোকা মানব’ নামে একটি অ্যাকাউন্ট ছিল বাবুর। তবে তিনি ফেইসবুকের কয়েকটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেখালেখি করতেন বেশি। ফেসবুকে তিনি ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।

বাংলাদেশে ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দেশে একের পর এক ব্লগার, প্রকাশক ও লেখক হত্যাকাণ্ড ঘটে। ওই তিন বছরে রাজধানীতে সাতটি জঙ্গি হামলায় আটজন খুন হন। আলোচিত এসব হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মাত্র একটির রায় হয়েছে। বাকি ছয়টি মামলার বিচারকাজ চলছে।

২০১৩ সালে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে মিরপুরে নিজ বাসার কাছে জঙ্গিদের চাপাতির কোপে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার। চার বছর পর এই মামলার রায়ে দুই জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড আর ছয়জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। উচ্চ আদালতেও সেই সাজা বহাল রয়েছে।

রাজীব খুন হওয়ার দুই বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় জঙ্গিদের হাতে খুন হন লেখক অভিজিৎ রায়। ওই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।

অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের মাসখানেক পরে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় হত্যা করা হয় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে। ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় খুন হন আরেক ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়।

ওই হত্যার আড়াই মাসের মাথায় ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে জঙ্গিদের হাতে খুন হন প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।