পৃথক চার 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত চার, আহত দুই
2017.07.26
ঢাকা

তীব্র সমালোচনার পরেও বাংলাদেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধে আসামি নিহত হওয়ার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত মাত্র ১৫-১৬ ঘণ্টার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে পৃথক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ চারজন নিহত ও দুজন আহত হয়েছে।
পুলিশ বলছে, এরা সকলেই ছিনতাইকারী। নিহতদের মধ্যে দু’জন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মিজানুর রহমান তালুকদার হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলেও ধারণা করছে পুলিশ।
রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকা থেকে ২৬০ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া শহরে বুধবার এসব বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। গত বুধবার ঢাকার আজিমপুরে দিনে দুপুরে কথিত ছিনতাইকারীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে র্যাব, যা নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
সন্দেহভাজন আসামিদের বিচার পাওয়ার সুযোগ না দিয়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন মানবাধিকারকর্মীরা। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
“কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পরে সন্দেহভাজন আসামিদের ঢালাওভাবে সন্ত্রাসী পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। এটা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন,” বেনারকে বলেন সাবেক মানবাধিকার কমিশনার মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, “বিষয়গুলো মানবিক এবং আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখা না হয়, তাহলে আমরা এই অভিশাপ থেকে কখনোই মুক্ত হতে পারব না।”
তাঁর মতে, অপরাধী বা অভিযুক্তদের জীবিত ধরে তথ্য আদায় করতে পারাটাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাফল্যের অন্যতম মাপকাঠি। তা না করে আসামিদের গুলি করে হত্যা করে নিজেদের ব্যর্থতার পরিচয় কেন দিচ্ছে সেটা কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা দরকার।”
দিনে দুপুরে বন্দুকযুদ্ধ
মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর আজিমপুরে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন। ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ’ লেখা স্টিকার লাগানো একটি গাড়ির ভেতর গুলিবিদ্ধ ওই দুই ব্যক্তি হলেন মনির হোসেন (৩৭) ও মোশাররফ হোসেন (৪২)। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
র্যাবের পক্ষ থেকে তাদের ছিনতাইকারী দাবি করা হলেও আহতরা তা অস্বীকার করেছেন।
র্যাব-১০-এর কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ফারুকী সাংবাদিকদের জানান, গুলিবিদ্ধ দুজনই সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী দলের সদস্য। তাঁরা পুলিশ ও ডিবি পরিচয় দিয়ে চকবাজার ও আজিমপুর এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতি করে আসছিল।
র্যাব কর্তৃপক্ষ জানায়, ছয়-সাতজন দুর্বৃত্ত একটি মাইক্রোবাস ও দুটি কার নিয়ে আজিমপুরে এতিমখানা মোড়ে ছিনতাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে- এমন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় র্যাব। এসময় ছিনতাইকারীরা একটি কারে করে পালানোর চেষ্টা করলে কারটি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে র্যাব। কারের ভেতর থেকে দুর্বৃত্তরাও র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
র্যাব-১০-এর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওই ঘটনায় দুজন কনস্টেবল আহত হয়েছেন বলেও জানানো হয়।
তবে এভাবে প্রকাশ্যে বন্দুকযুদ্ধের সমালোচনা করে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, “এতে করে জনমনে ভীতি তৈরি হবে। এটা সঠিক উপায় নয়।”
মিরপুরে বন্দুকযুদ্ধে নিহতরা পুলিশের এএসপি হত্যাকারী
আজিমপুরের ঘটনার রেশ না কাটতেই রাজধানীর মিরপুরে বেড়িবাঁধ এলাকায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুইজন ‘ছিনতাইকারী’ নিহত হয়। পুলিশের ধারণা, তারা সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মিজানুর রহমান তালুকদার হত্যাকাণ্ডে জড়িত।
গত ২১ জুন দুপুরে মিরপুর বেড়িবাঁধসংলগ্ন বিরুলিয়া সেতুর কাছে রাস্তার পাশের ঝোপ থেকে মিজানুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি হাইওয়ে রেঞ্জের সাভার সার্কেলের দায়িত্বে ছিলেন।
পরে ২৩ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম জানান, মিজানুর রহমান ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত হন।
বেড়িবাঁধে বন্দুকযুদ্ধে নিহত দুজনের পরিচয় নিশ্চিত করা না গেলেও গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (পশ্চিম) গোলাম মোস্তফা সাংবাদিকদের জানান, ছবি দেখে ধারণা করা হচ্ছে, এরা জাকির ও ফারুক। তারা এএসপি মিজানের হত্যাকারী।”
বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ অস্বীকার করে বুধবার রাজধানীর রূপনগর থানার এসআই মোমিনুর রহমান বলেন, বেড়িবাঁধ এলাকায় ছিনতাইকারীর দল জড়ো হচ্ছে—এমন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে অবস্থান নেয় ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের একটি দল। ছিনতাইকারীরা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ছুড়লে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। একপর্যায়ে ছিনতাইকারীদের কয়েকজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
“ঘটনাস্থল থেকে পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দুজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে থেকে আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় একজন পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন। তবে আঘাত গুরুতর নয়,” জানান তিনি।
কুষ্টিয়ায় নিহত ২ জন
মিরপুরে বন্দুকযুদ্ধ চলার কাছাকাছি সময়েই কুষ্টিয়া সদর ও ভেড়ামারা উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নুল আবেদীন।
বুধবার ভোরে সদর উপজেলার বাড়াদী ও ভেড়ামারা উপজেলার দশমাইলে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি দেশি শাটারগান, দুটি গুলি ও করাত উদ্ধার করেছে পুলিশ।
নিহতরা হলেন - কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সোবহান আলী (৩৭) ও মেহেরপুর জেলার মনোহরদিয়া হাসানুজ্জামান (৩৫)।
জয়নূল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, বুধবার ভোরের দিকে খবর আসে সদর উপজেলার বাড়াদী ও ভেড়ামারা উপজেলার দশমাইলে সড়কে গাছ ফেলে ডাকাতি হচ্ছে। উভয় জায়গায় পুলিশের পৃথক দল অভিযান চালায়। সেখানে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে ডাকাতদল। জবাবে পুলিশ পাল্টা গুলি করলে ঘটনাস্থলেই দুই ডাকাত মারা যায়।”
তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় হত্যা, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানায় পুলিশ।
“জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন অনেক তৎপর। তাঁদের অপারেশন চলাকালে এমন বন্দুক যুদ্ধের খবর শোনা যাচ্ছে। তবে এসব অপারেশনের সময় যাতে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে কঠোর নজর রাখতে হবে,” বেনারকে বলেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।