দিনাজপুরের ‘মানবপল্লী’ বদলে দিচ্ছে হিজড়াদের জীবন

কামরান রেজা চৌধুরী
2017.03.21
ঢাকা
দিনাজপুরের 'মানবপল্লী’তে সাধারণ মানুষদের সাথেই হিজড়ারা বসবাস করছেন। দিনাজপুরের 'মানবপল্লী’তে সাধারণ মানুষদের সাথেই হিজড়ারা বসবাস করছেন। মার্চ ০৭, ২০১৭।
কামরান রেজা চৌধুরী/বেনার নিউজ

সমাজে অবহেলার শিকার হিজড়াদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর ফলে ভাগ্যের পরিহাসের শিকার হয়ে পরিবার কিংবা সমাজচ্যুত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো আবারও স্বপ্ন দেখছেন।

দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুরে স্থাপিত ‘মানবপল্লী’ নামক কেন্দ্রে সাধারণ মানুষের সঙ্গে এখন সমাজচ্যুত হিজড়ারা বসবাস করছেন। এমন উদাহরণ দেশে এই প্রথম।

সরকারি এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বেরিয়ে অনেক হিজড়াই হয়ে উঠছেন আত্মনির্ভরশীল, যা তাঁদের ‘হিজড়া’ পরিচয়ের বাইরে নতুন করে পরিচিত করছে।

২৪ বছর বয়সের একজন হিজড়া বেনারকে শোনান নিজের সেই দুঃখ দুর্দশার দিন থেকে বেরিয়ে আসার গল্প। পনেরো বছর আগে মাত্র নয় বছর বয়সে বা-মার নিষ্ঠুর আচরণে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন সুমন।

সেদিনের কথা স্মরণ করে তিনি বেনারকে বলেন, “ওই দিন বাড়ির নিচতলায় আমারই বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল। অথচ আমাকে বাসার ছাদে বেঁধে রাখে বাবা-মা, যাতে আমি বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে না পারি। কারণ, আমি হিজড়া। আমাকে দেখলে অনুষ্ঠানের ক্ষতি হতে পারে।”

দিনাজপুর শহরের ফল ব্যবসায়ী মনসুর আলীর তিন সন্তানের একজন সুমন। ছেলে হয়ে জন্ম নিলেও ধীরে ধীরে মেয়েলি স্বভাব ধারণ করে সে। এ কারণে পাড়ার সবাই তাকে ঘৃণা করত, উত্যক্ত করত।

সুমন বলেন, “বোনের বিয়ের দিনে ওই ঘটনার পর আমি মনের দুঃখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। এরপর এক ব্যক্তি আমাকে ঢাকায় একটি বাসায় কাজ দেয়। ওরা আমাকে নিয়মিত খেতে দিত; কিন্তু একটি ঘরে আটকে রাখত, শারীরিক নির্যাতন করত, কঠোর পরিশ্রম করাত।”

সুমন জানান, তারপরও সেখানে আট বছর কাজ করেছেন। একদিন তিনি ওই বাসা থেকে পালিয়ে দিনাজপুর চলে যান। তবে বা-মার কাছে না গিয়ে একটি স্বর্ণের দোকানে কাজ নেন তিনি।

“আমি স্বর্ণের কাজ শিখি। কিন্তু দোকানদার আমাকে রাতে তার সঙ্গে থাকতে বলত। তাই কাজ ছেড়ে দেই। এরপর ২০১১ থেকে সরকারের সাহায্যে এই মানবপল্লীতে অন্যান্য হিজড়াদের সঙ্গে থাকছি,” বলেন সুমন।

সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে সুমন বলেন, “আগে শুধু একটা আশ্রয় ও পেটের ভাতের জন্য সব নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এখন এলাকার মানুষ আমাদের আর বিরক্ত করে না। দেশের অন্যান্য হিজড়াদের এমন সুযোগ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

সরেজমিন হিজড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র

দিনাজপুরের বাংগিবেচা এলাকায় দেশের একমাত্র হিজড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রটিতে ৮০ জন হিজড়া বসবাস করেন। স্বাভাবিক মানুষও থাকছেন তাঁদের সঙ্গে।

উপজেলা প্রশাসন বলছে, ২০১১ সালে দিনাজপুর শহরের অদূরে পাঁচ একর ছয় শতক সরকারি জমিতে হিজড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আশ্রায়ণ প্রকল্পের আওতায় মোট ৮০ জন হিজড়াকে আলাদা আলাদা ঘর দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবদুর রহমান বলেন, “প্রত্যেক হিজড়ার নামে একটি ঘর নিবন্ধন করে দেওয়া হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে তাঁদের কেউ উচ্ছেদ করতে না পারে।”

সাথি হিজড়া উন্নয়ন সংঘ নামক একটি সংগঠনের মাধ্যমে সেখানকার হিজড়ারা এই মানবপল্লী তদারকি করেন।

সংঘের সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ বেনারকে বলেন, “আমি ২০০০ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করি। এসএসসির ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় আমার শিক্ষকেরা বলতেন, তোর পরীক্ষা দিতে হবে না। তুই একটু আমাদের সামনে হাঁটাচলা কর। এটাই তোর পরীক্ষা।”

“আমি হাঁটলে আমার শিক্ষক ও সহপাঠীরা হাসত । এভাবেই আমাকে সবাই হেয় করত,” জানান ফিরোজ।

সংঘের সভাপতি মেনেকা আহমেদ বাপ্পি বেনারকে বলেন, “পুনর্বাসন কেন্দ্রে আমরা কমিটির মাধ্যমে আমাদের নামে বরাদ্দ পুকুরে মাছ চাষ করি। এ ছাড়া ২০১১ সালে আমাদের ২৩টি গরু দেওয়া হয়। এখন গরুর সংখ্যা ৫০।”

তিনি বলেন, “আমাদের পল্লিতে ৮০জন হিজড়া ছাড়াও আমাদের মা-বাবা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা থাকেন। তারা হিজড়া নন। অনেক সাধারণ মানুষ আমাদের সঙ্গে থাকে। আমরা এই পুনর্বাসনে অত্যন্ত আনন্দিত।”

সরকারি সূত্রে জানা যায়, এই পল্লী হিজড়াদের পুনর্বাসনের জন্য একটি মডেল। বাংলাদেশের আর কোনো স্থানে হিজড়াদের আলাদা থাকার ও সমাজে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানান বাপ্পি।

হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন বন্ধু ওয়েলফেয়ার সোসাইটির পরিচালক ফসিউল আহসান বেনারকে বলেন, “দীর্ঘদিন থেকেই আমরা সরকারের কাছে হিজড়াদের আবাসন ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে আসছি। কারণ, তাদের কেউ বাড়ি ভাড়া দেয় না। সুতরাং, দিনাজপুরে হিজড়াপল্লী স্থাপন একটি ভালো উদ্যোগ।”

সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা দশ হাজার বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা পনেরো হাজার জানিয়ে ফসিউল বলেন, “এদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজের সুবিধা দিতে হবে। এর মাধ্যমে তাঁরা সমাজের মূল ধারায় ফিরে আসবে।”

দিনাজপুরে হিজড়াপল্লীর উল্টো দিকে মুদি দোকান চালান আশরাফ আলী। তিনি বেনারকে বলেন, “প্রথমে আমরা স্থানীয় জনগণ এলাকায় হিজড়াদের আবাসনের বিপক্ষে ছিলাম। এখন আমরা দেখছি হিজড়ারা কারও ক্ষতি করে না। এদের কাছে টেনে নিলে এরা মানুষকে ভালোবাসা দেয়। অধিকাংশ হিজড়া গ্রামের মানুষদের সম্মান করে।”

আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ

বাংলাদেশের প্রথম এই হিজড়া পুনর্বাসন একটি সফল উদ্যোগ হিসেবে আন্তর্জাতিক ওয়ার্ল্ড লিডারশিপ ফেডারেশন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রহমান বেনারকে বলেন, “যখন আমরা হিজড়াপল্লী স্থাপনের জন্য বাংগিবেচা স্থানকে নির্বাচন করি, তখন কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী রাতারাতি ওই জমিতে ১০৮টি ঘর তোলে। একই সঙ্গে শত শত মানুষ হিজড়া পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে মিছিল শুরু করে।”

পুলিশ প্রহরায় অভিযান চালিয়ে ঘরগুলো উচ্ছেদ করা হয় বলে জানান তিনি।

রহমান বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলসহ বিভিন্ন ফান্ড থেকে ৩০ লাখ টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে হিজড়াদের। এরা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করছে। একই সঙ্গে হিজড়াপল্লীর পাশে একটি পুকুর তাদের দেওয়া হয়েছে। এখানে তারা মাছ চাষ করে।”

তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষও এখন এদের সঙ্গে অবস্থান করছে। এটা একটা বড় অর্জন।”

হাসপাতাল বা ক্লিনিকে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে হিজড়ারা নিয়ে বড় করে বলেও জানান রহমান।

কাঁচামালের ব্যবসায়ী পারভিন বেগম তাঁর ২০ বছর বয়সী ছেলে মো. জসিমকে নিয়ে গত দুই বছর ধরে এই হিজড়া পল্লিতে থাকেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমি গরিব মানুষ। একজন হিজড়া আমাকে সপরিবারে থাকতে দিয়েছে। অনেকেই আমাকে আসতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু দেখছি, হিজড়ারা ভালো। তারা তো আমাদেরই সন্তান। এদের অবহেলা করা ঠিক না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।