স্বীকৃতি পেলেও সুফল বঞ্চিত তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা

শরীফ খিয়াম
2018.04.03
ঢাকা
ঢাকায় বাংলাদেশের প্রথম হিজড়া প্রাইড ডে’র শোভাযাত্রায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা। ঢাকায় বাংলাদেশের প্রথম হিজড়া প্রাইড ডে’র শোভাযাত্রায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা। ১০ নভেম্বর ২০১৪।
মনিরুল আলম/বেনারনিউজ

চার বছর আগে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ স্বীকৃতি পেলেও হিজড়া জনগোষ্ঠী এখনো যেমন জাতীয় পরিচয়পত্রে নিজস্ব লিঙ্গ পরিচয় উল্লেখ করতে পারেন না, তেমনি তৈরি হয়নি তাঁদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইন।

“সরকার তৃতীয় লিঙ্গ স্বীকৃতি দেওয়ার পরও বাস্তবে এর তেমন কোনো সুফল পায়নি হিজড়ারা,” বেনারকে বলেন যৌন সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করা উন্নয়ন সংস্থা বন্ধু ওয়েলফেয়ার সোসাইটির (বিএসডব্লিউএস) প্রোগ্রাম ম্যানেজার উম্মে ফারহানা জারিফ কান্তা।

“তবে ইদানীং কিছু কাজ শুরু হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্রে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ অন্তর্ভুক্ত করার কাজ শুরু হলেও খুব দ্রুত বিষয়টির নিষ্পত্তি হবার সম্ভাবনা নেই বলে জানা গেছে নির্বাচন কমিশন সূত্রে।

“গত জানুয়ারিতে গঠিত এক বিশেষ কমিটি এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে,” বেনারকে জানান ইসি’র অতিরিক্ত সচিব মো. মোখলেসুর রহমান।

তবে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে তাঁদেরকে আগের মতোই নারী বা পুরুষ হিসেবে পরিচিত থাকতে হবে। কারণ “প্রক্রিয়াটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ,” বলেন ইসি’র পরিচালক (জনসংযোগ) এস এম আসাদুজ্জামান।

তিনি বলেন, “হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ভোটার করার প্রক্রিয়া খুব দ্রুত শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কাজ এখনো এগোয়নি সেভাবে। ‘ইমপ্যাক্ট’ কী হবে, কোন কোন আইন ও বিধির কোথায় কী পরিবর্তন করতে হবে তা খতিয়ে দেখছে কমিটি।”

গত ২৭ ডিসেম্বর ইসি’র এক সভা বিবরণীতে বলা হয়, “হিজড়ারা ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাঁধা নেই। কিন্তু তথ্য সংগ্রহে লিঙ্গ পরিচয় হিসেবে নারী ও পুরুষের পাশাপাশি হিজড়া উল্লেখ করার জন্য বিদ্যমান আইন-বিধি সংশোধনের প্রয়োজন।”

প্রসঙ্গত গত ২১ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে হিজড়া নাদিরা খানম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। তিনি ওই নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসনের প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

তবে “এর আগে যশোরের বাঘারপাড়া ও সাতক্ষীরার কলারোয়া পৌরসভায় তৃতীয় লিঙ্গের যে দুজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তাঁরা লিঙ্গ-পরিচয় প্রকাশ করেননি,” বেনারকে জানান ফারহানা জারিফ কান্তা।

এদিকে প্রয়োজনীয় আইন-বিধি সংশোধনের পর ভোটার নিবন্ধন ফরমে ‘নারী’ ও ‘পুরুষের’ পাশাপাশি ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ যুক্ত হবে বলে ১৮ জানুয়ারি সাংবাদিকদের জানান ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।

এরপর থেকে হিজড়ারা স্বতন্ত্র পরিচয়ে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।

উত্তরাধিকার বিষয়ক জটিলতা

“হিজড়াদের সম্পত্তির অধিকার নিয়ে বেশ আগে থেকেই আলোচনা হচ্ছে” বলে কান্তা জানালেও নীতিমালা তৈরির বিষয়টি বর্তমান সরকারের আমলে বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানান সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নূরুল কবির।

এ প্রসঙ্গে ইসি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “কারণ এর সাথে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। যেমন, মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে শুধু ছেলে-মেয়ের কথা বলা আছে। যে কারণে তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয়ে পৈতৃক সম্পত্তি পাওয়ার সুযোগ নেই।”

“এটা খুব জটিল জায়গা। এখানকার আইন অনুযায়ী ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে বেশি সম্পত্তি পায়,” বেনারকে বলেন কান্তা।

কান্তা জানান, “হিজড়ারা নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেনি। তারা ‘থার্ড জেন্ডার’ হিসেবে সম্পত্তির ভাগ চায়, নাকি ভাই বা বোন হিসেবে চায় তা নিয়ে তাদের সাথে বহুবার আলোচনা হয়েছে।”

“তৃতীয় লিঙ্গের ভাগ কতটুকু হবে সে বিষয়টি এখনো নির্ধারিত হয়নি” উল্লেখ করে কান্তা বলেন, “তবে হিজড়ারা নিজেকে যে পরিচয় দেবে, সে অনুযায়ীই তাকে সম্পত্তি দেওয়া উচিত।”

এদিকে হিজড়াদের সম্পত্তির অধিকার বিষয়ক আইনের “খসড়ায় এখনো হাত দেওয়া যায়নি,” বলে জানান সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

তিনি বলেন, “খুব ছোট একটা আইন প্রণয়ন করা হবে। এ লক্ষ্যে চলতি (এপ্রিল) মাসে আমরা হিজড়াদের মতামত নেব। তাদের গুরু মাতাদের ডাকা হবে। এরপর আইনের কাঠামো তৈরির কাজ শুরু করা হবে।”

“সবার মতামত নিয়ে তা বিশ্লেষণ করে এই আইনের নীতিনির্দেশনা সংক্রান্ত নথিপত্র তৈরি করতে বেশ সময় লাগবে। আগামী অক্টোবরের মধ্যে এটা সংসদে উত্থাপনের সম্ভাবনা খুবই কম,” যোগ করেন তিনি।

স্বীকৃতি ও সহায়তা

২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর পর ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের লিঙ্গ পরিচয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশিত হয়।

সরকারি হিসাবে দেশে প্রায় দশ হাজার হিজড়া রয়েছেন, তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা আরো বেশি বলে দাবি করা হয়।

বর্তমানে মেডিকেল চেকাপের মাধ্যমে হিজড়া পরিসংখ্যানের লক্ষ্যে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।

এই প্রকল্পের আওতায় সরকারিভাবে চিহ্নিত হিজড়াদের একটি স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে।

২০১২-১৩ অর্থবছরে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য একটি কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার।

তিন বছর ধরে এই কর্মসূচিতে কর্মরত সমাজসেবা অফিসার বেগম ফারহানা ইয়াসমিন বেনারকে জানান, গত ৫ বছরে সারা দেশের ৭ হাজার হিজড়া বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। চলতি বছরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন আরও ১ হাজার ৯০০ জন।

তবে “নতুন পেশায় নিজেকে দাঁড় করাতে সক্ষম হওয়া হিজড়ার সংখ্যা খুবই কম,” বলেন ফারহানা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।