অধিকার নিশ্চিতে আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয় চান হিজড়ারা
2018.04.26
ঢাকা

বাংলাদেশের তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগের দাবি জানিয়েছেন হিজড়ারা। তাঁদের দাবি, প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের ন্যূনতম মানবাধিকার নিশ্চিতে বেশ কিছু নতুন আইন করতে হবে।
যৌন সংখ্যালঘু হিজড়া জনগোষ্ঠীর গুরু মাতা, পুলিশ, আইনজীবী, সাংবাদিক, গবেষক ও উন্নয়নকর্মীদের এমন সুপারিশের সাথে একমত হয়েছে সরকারের সমাজসেবা অধিদফতর। তাঁদের আয়োজনে বৃহস্পতিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময়ে এসব কথা উঠে আসে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার বেনারকে বলেন, “মতবিনিময়ে পাওয়া সুপারিশগুলো নিয়ে সমাজকল্যাণ সচিবের উপস্থিতিতে উচ্চপর্যায়ের (স্টিয়ারিং কমিটির) বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আশা করি এগুলো অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা যাবে।”
হিজড়াদের অভিমত, “শুধু সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দিয়ে তাঁদের সামাজিক উন্নয়ন ও অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সবগুলো মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি থাকা দরকার।”
আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার বলেন, “হিজড়াদের প্রকৃত উন্নয়ন করতে হলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, তথ্য, স্বরাষ্ট্রসহ প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমন্বয় কমিটি থাকাটা ভালো।”
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গাজী মোহাম্মদ নূরুল কবিরের সঞ্চালনায় মতবিনিময়ে অংশগ্রহণকারীরা আরও বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকদের ব্যাপারে সমাজের ‘নেতিবাচক মনোভাব’ কাটাতে জনসচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।
তাঁদের মতে, জনসাধারণের ভীতি কাটাতে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে। আগামী প্রজন্মের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকে তৃতীয় লিঙ্গ বিষয়ক লেখা থাকা দরকার।
সভায় প্রত্যেক হিজড়া বক্তা সরকারিভাবে তৃতীয় লিঙ্গ চিহ্নিতকরণে বিদ্যমান পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করেন। এটাকে তাঁরা ‘যৌন নিপীড়নের শামিল’ বলে অভিযোগ করেন।
সরকারিভাবে হিজড়াদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণের আগে তৃতীয় লিঙ্গের ‘সংজ্ঞা’ নির্ধারণ করারও দাবি তোলা হয়।
আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার বলেন, “আমরা মনে করেছি ডাক্তারি পরীক্ষাই যথেষ্ট। কিন্তু আজকের আলোচনায় বেরিয়ে এসেছে এখানে মানসিক একটা বিষয় আছে।”
“হিজড়া জনগোষ্ঠীর পরিচয় যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ডাক্তারি পরীক্ষার সাথে অবশ্যই একজন মনোবিজ্ঞানী রাখতে হবে। তবে প্রকৃত হিজড়ার সংখ্যা নির্ধারণ নিয়ে ঝামেলা আছে,” যোগ করেন তিনি।
সভায় সরকারি ও বেসরকারি হিসাবে দেশে মাত্র সাত থেকে ১০ হাজার তৃতীয় লিঙ্গে থাকার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর জোনের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) জসীম উদ্দিন মোল্লা এবং উত্তরা জোনের (এসি) মো. মিজানুর রহমান।
তাঁরা জানান, শুধু ঢাকার মিরপুর এবং উত্তরায় এর চেয়ে বেশি হিজড়া আছেন। সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়রাও একমত পোষণ করেন পুলিশের সাথে।
দীর্ঘদিন ধরে যৌন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার বেসরকারি সংস্থা বন্ধু ওয়েলফেয়ার সোসাইটির (বিএসডব্লিউএস) কর্মর্তাদের মতে দেশে মোট হিজড়ার সংখ্যা অন্তত ৩০-৩৫ হাজার।
বাংলাদেশের তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে তাঁদের সঠিক সংখ্যা বের করা সবচেয়ে জরুরি বলেও মত দেন আলোচকেরা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা হিজড়াদের অপরাধ প্রবণ হওয়ার পেছনে তাঁদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক মনোভাবকে দায়ী করেন।
আবদুর রাজ্জাক হাওলাদার বলেন, “প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে সরকার এত পজিটিভ যে এখন আর কোনো পরিবারে প্রতিবন্ধী বাচ্চা জন্মালে তাকে বোঝা মনে করা হয় না। হিজড়াদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা করতে হবে।”
হিজড়াদের সম্পত্তির অধিকার দেওয়ার বিষয়টি ‘সময়-সাপেক্ষ’ উল্লেখ করে তিনি জানান, “একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে। আইনজীবীদের সাথেও কথা বলা হয়েছে।”
“তবে শুধু সম্পত্তির ক্ষেত্রে নয়, সর্বত্র হিজড়াদের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে আরও সুনির্দিষ্ট কিছু আইন দরকার বলে আলোচনায় এসেছে। নয়তো শারীরিক ও মানসিকভাবে তাঁদের হয়রানির শিকার হতেই হবে,” বলেন এই কর্মকর্তা।
বর্তমান কর্মসূচি যথেষ্ট নয়
‘সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী’ বিভাগে ২০১৬ ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’ পুরস্কার পাওয়া জামালপুরের হিজড়া আরিফা ইয়াসমিন ময়ূরী মতবিনিময় শেষে বলেন, “রাজ্জাক স্যার (প্রকল্প পরিচালক) যেসব সুপারিশ লিখে নিয়ে গেছেন, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের প্রতিটি হিজড়া উপকৃত হবে।”
“সরকারের এই উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় আমরা আশাবাদী। নিশ্চয়ই হিজড়াদের জন্য কল্যাণকর কিছু হবে, সেটাই আমরা চাই,” বেনারকে বলেন সংস্থা বন্ধু ওয়েলফেয়ার সোসাইটির কর্মকর্তা উম্মে ফারহানা জারিফ কান্তা।
তবে হিজড়াদের অভিযোগ, তাঁদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় সরকার যেসব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে তা বাজার যাচাই না করেই করা হয়েছে। পুনর্বাসন ভাতার পরিমাণও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উপযোগী নয় বলে তাঁদের মত।
প্রসঙ্গত, ২০১২-১৩ অর্থবছরে চালু হওয়া কর্মসূচির আওতায় গত পাঁচ বছরে সারা দেশে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ পাওয়া হিজড়ার সংখ্যা সাত হাজার। চলতি বছরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন আরও এক হাজার ৯০০ জন। প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেকে ১০ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ পরিচয়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানকারী নীতিমালা অনুমোদিত হয়। এরপরই হিজড়াদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হয় সরকারি দপ্তরগুলো।