নির্বাচনী ফলে গড় মিলের প্রতিবেদন করায় সাংবাদিক রিমান্ডে
2019.01.02
ঢাকা

নির্বাচনী ফলাফলে গড় মিল দেখিয়ে প্রতিবেদন করায় ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদক হেদায়েত হোসেন মোল্লাকে গ্রেপ্তারের একদিন পর বুধবার তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ওই সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করায় বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক সমাজে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
“নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে,” বেনারকে বলেছেন খুলনার জেলা প্রশাসক ও নির্বাচনকালীন রিটার্নিং কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন।
“সরকার কথা দিয়েছিল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই আইন ব্যবহার করা হবে না। অথচ সাংবাদিকতার দায়ে একজনকে ওই আইনে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আইনটি নিয়ে আমরা যে শঙ্কার কথা বলেছিলাম, এই ঘটনায় তার যথার্থতা আবারও প্রমাণিত হলো,” বেনারকে বলেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহসভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম বেনারকে বলেছেন, “নির্বাচনী প্রতিবেদন পাঠানোর সময় তাড়াহুড়ার কারণে ভুল হতেও পারে। সে জন্য একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়।”
তিনি বলেন, “আমরা সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যাপারে প্রথম থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছি। ওই আইনের কিছু ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছি। ধারাগুলো সংশোধন করা অত্যন্ত জরুরি।”
কেন এই মামলা?
গত ৩০ ডিসেম্বর খুলনা জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন তাঁর কার্যালয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেন। ওই ফলাফলে খুলনা-১ আসনে মোট ভোটারের চেয়ে ২২ হাজারেরও বেশি ভোট গ্রহণ হয়েছে মর্মে ঢাকা ট্রিবিউনের অনলাইন সংস্করণে এবং দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনটি সঠিক ছিল না দাবি করে ঢাকা ট্রিবিউনের খুলনা প্রতিনিধি হেদায়েত হোসেন মোল্লা ও মানবজমিনের প্রতিনিধি রাশিদুল ইসলামকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবাশীষ চৌধুরী। মামলায় হেদায়েতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাশিদুল ইসলাম পলাতক রয়েছেন।
স্থানীয় সাংবাদিকেরা বলছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল প্রদানের সময় ভোট প্রদানের ভুল তথ্য মাইকে ঘোষণা করেছিলেন। এটা সবাই শুনেছে এবং তার ভিত্তিতেই হেদায়েত ও রশিদুল ঢাকায় তাঁদের কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন।
মাছরাঙা টেলিভিশনের খুলনা ব্যুরো প্রধান মোস্তফা জামান পাপলু ফলাফল ঘোষণার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
বেনারকে তিনি বলেছেন, “রিটার্নিং অফিসার সবার সামনে মাইকে ঘোষণা করেছিলেন খুলনা-১ আসনে ১০৭টি কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী নৌকা প্রতীকে ২,৫৩,৬৬৯ হাজার এবং ধানের শীষ প্রতীকে ২৮,১৭০ ভোট পড়েছে। অথচ সেখানে মোট ভোটার ২,৫৯,৩৫৬। ঘোষিত ফলাফল মোট ভোটার সংখ্যার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়ায় অনেকেই সেখানে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।”
তবে খুলনার জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন বেনারকে বলেন, “ওই দুই সাংবাদিক যে রিপোর্ট করেছিলেন তা তথ্যভিত্তিক ছিল না। আমার কাছে যে লিখিত ফলাফল এসেছে আমি তাই ঘোষণা করেছি। সেটাই আমরা কমিশনে পাঠিয়েছি। মোট ভোটারের চেয়েও ২২ হাজার ভোট বেশি কাস্ট হওয়ার তথ্য তারা কোথায় পেলেন, তা আমি জানি না।”
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করা হবে না, সরকার এর আগে এ রকম কথা দিলেও ওই আইনে মামলা করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন আমাদের যা নির্দেশ করেছে আমরা তাই করেছি।”
ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান বেনারকে বলেন, “আমাদের পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে তাৎক্ষণিক ফলাফলগুলো তুলে ধরা হচ্ছিল। সেই ফলাফলগুলো তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করার সুযোগ ছিল না।
তিনি বলেন, “খুলনা-১ আসনের ফলাফল নিয়ে অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্য সংক্রান্ত ওই প্রতিবেদনটি কিছুক্ষণ পরই প্রত্যাহার করা হয়েছিল। আমরা প্রিন্ট ভার্সনে সেই রিপোর্ট ছাপাইনি। এই জন্য একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা কাঙ্খিত নয়। এ রকম বিষয় আন্তরিকতার সঙ্গে সমাধান করার সুযোগ থাকে।”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পর থেকেই বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে মানসিক চাপের মধ্যে আছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জিটিভির প্রধান প্রতিবেদক রাজু আহমেদ।
তিনি বলেন, “আইনটি পাস হওয়ার পর থেকে কেউ ভয় না দেখালেও রিপোর্ট প্রচারের সময় মনের মধ্যে ভয় কাজ করে। কোনো তথ্য সংবেদনশীল মনে হলে নিজ দায়িত্বেই তা চেপে যেতে হয়।”
নিন্দা ও উদ্বেগ
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনায় নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশ, মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন (এমইউজে), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (রাবিসাস)।
আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে গ্রেপ্তার সাংবাদিককে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার এবং দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।