৫৭ ধারায় মামলার হিড়িক ঠেকাতে পুলিশ প্রধানের নির্দেশ
2017.08.03
ঢাকা

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) ৫৭ ধারায় মামলা দায়েরের হিড়িক ও হয়রানি ঠেকাতে শেষ পর্যন্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নির্দেশনা জারি করেছেন। এখন থেকে মামলা নেওয়ার আগে সদর দপ্তরের অনুমতি নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে পুলিশের সব কটি ইউনিটকে।
পুলিশের সব কটি ইউনিটে গত বুধবার পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে কোনো কোনো জায়গায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে। অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা ও নিরীহ ব্যক্তি যেন সাজা না পান তা নিশ্চিত করতেই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক সহেলী ফেরদৌস বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। বেনারকে তিনি জানান, চিঠিতে মামলা রুজুর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য ভার্চ্যুয়াল জগৎকে নিরাপদ করতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ প্রণীত হয়। ২০১৩ সালে বেশ কিছু সংশোধনী যুক্ত করে আইনটিকে কঠোর করা হয়। এর মধ্যে ৫৭ ধারার মামলা আমলযোগ্য, অজামিনযোগ্য ও সর্বনিম্ন সাজা সাত বছরের কারাদণ্ড করায় এর অপব্যবহার শুরু হয়।
মামলার শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, আইনজীবী মৎস্যজীবী ও শ্রমিক। মামলার বড় অংশের বাদীও ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও সাংসদদের অনুসারীরা। মামলা করেছেন, বিচারক, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররাও।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩১ জুলাই খুলনার ডুমুরিয়ার সাংবাদিক আবদুল লতিফ মোড়ল মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের বিতরণ করা একটি ছাগল মরে যাওয়ার খবর ফেসবুকে শেয়ার করলে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে দেন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজন সুব্রত ফৌজদার। তাঁর দাবি, এই খবর শেয়ার করায় মন্ত্রীর মানহানি হয়েছে। একদিন জেল খেটে বুধবার লতিফ জামিনে মুক্ত হন।
এক প্রশ্নের জবাবে লতিফ বেনারকে বলেন, “আমার এই হয়রানির জন্য প্রতিমন্ত্রী ১০০ ভাগ দায়ী। মন্ত্রীর রোষানলে পড়ে আমাকে জেল খাটতে হয়েছে।”
প্রতিমন্ত্রী অবশ্য বুধবার বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
ছয় মাসে ৩৯১টি মামলা
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেবে গত ছয় মাসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ৩৯১টি মামলা হয়েছে। এর বড় অংশই ৫৭ ধারায় দায়ের করা। সাইবার ট্রাইব্যুনাল বলছে, দায়ের হওয়া মামলাগুলোর ৯৪ ভাগ ৫৭ ধারার। দেশে সাইবার অপরাধের বিচার হয়ে থাকে এই ট্রাইব্যুনালে।
পুলিশ সদর দপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বেনারকে বলেন, ধারাবাহিকভাবে এই ধারায় দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা বাড়ছে। মাঠপর্যায় থেকেই বলা হয়েছে, ৫৭ ধরার মামলা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তাঁরা ঝামেলায় পড়ছেন।
সদর দপ্তরের হিসেবে এ বছরের জানুয়ারিতে মামলা ছিল ৪২টি, ফেব্রুয়ারিতে ৬৭টি, মার্চে ৭১টি, এপ্রিলে ৬৩টি, মে মাসে ৬৯টি এবং জুনে ৭৯টি মামলা দায়ের হয়।
সর্বশেষ গত বুধবারও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংবাদিক সীমান্ত খোকনের বিরুদ্ধে নবীনগর থানায় একটি মামলা হয়েছে।
৫৭ ধারা কী, কেন এত মামলা
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।”
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট এর সাম্মানিক পরিচালক সারা হোসেন বেনারকে বলেন, “তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় যে যে অপরাধের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা নেই। ফলে, যে যার ইচ্ছেমতো মামলা ঠুকে দিচ্ছেন এই বলে যে তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।"
উল্লেখ্য, এ আইনে অপরাধ বলে গণ্য মিথ্যা ও অশ্লীল, নীতিভ্রষ্টতা, মানহানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি শব্দগুলোর ব্যাখ্যা নেই।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত বছর বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে ৫৭ ধারায় ৩৫টি মামলার উল্লেখ করা হয়। এর ১৬টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মানহানি হয়েছে এই অভিযোগে। মামলা করেছেন, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
আমলযোগ্য হওয়ায় পুলিশ অভিযোগ দায়ের হলেই গ্রেপ্তার করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলে রসরাজ দাস তাঁদের একজন। পুলিশ বলছে, ফরেনসিক পরীক্ষায় তাঁর ফেসবুক থেকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। কিন্তু তার আগেই তাঁকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার দায়ে এই ধারায় তিন মাস জেল খাটতে হয়। এ বছরের জানুয়ারিতে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইন্টিন ৫৭ ধারার আইনগত বিশ্লেষণ করে গত বছর। আর্টিকেল নাইন্টিনের এ দেশীয় পরিচালক তাহমিনা রহমান বেনারকে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা সংবিধানের ৩৯ ধারায় মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি এই ৫৭ ধারা প্রত্যাহার চান।
আক্রান্ত ২০ সাংবাদিক
এ বছরের প্রথম সাত মাসে ২০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়। এই সাংবাদিকেরা সংবাদ ছেপে মামলার শিকার হন। তবে সংবাদ শেয়ার করে ও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্যও দুজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এই সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁদের কার্যালয় থেকে।
এই ধারার প্রথম দিকের শিকার সাংবাদিক প্রবীর সিকদার। ২০১৫ সালে তাঁর বিরুদ্ধে ফরিদপুরে একজন মন্ত্রীর পক্ষে মামলা করেন একজন আইনজীবী। ব্যাপক সমালোচনার মুখে প্রবীর সিকদার জামিনে মুক্তি পান ঠিকই, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার হয়নি। বিচার শুরু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রবীর সিকদার নিজেই।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বেনারকে বলেন, সরকারকে বিতর্কিত করতে সরকারের ভেতরকার একটি অংশ এই ধারার প্রয়োগ করছেন এবং এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।