ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে বাউল রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

প্রাপ্তি রহমান
2020.12.02
ঢাকা
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে বাউল রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঢাকার দোহারে একটি আসরে বাউল গান করছেন রিতা দেওয়ান। ২ নভেম্বর ২০২০।
[এএফপি]

পালাগানের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।
বুধবার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন।  

সাইবার ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম শামীম বেনারকে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, “রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধর্ম অবমাননার মামলা হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই​) অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পায়। তারই ভিত্তিতে আজ পরোয়ানা জারি হলো।” 

এই মামলায় শাহজাহান ও ইকবাল নামে আরও দুজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বলেও জানান তিনি।

তিনি বলেন, “রিতা দেওয়ান তাঁর গানে আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে কটুক্তি করেন। ওই গান শাহজাহান ও ইকবাল কিনে নিয়ে ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করেন।

উল্লেখ্য, গত ২ ফেব্রুয়ারি আইনজীবী ইমরুল হাসান বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। এর পরপরই রূপালি এইচডি নামে ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে রিতা দেওয়ান তাঁর দুই মেয়েসহ হাজির হয়ে ক্ষমা চান।

মুসলিম ভাইবোনদের কাছে আমি বলব, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমি যেন আর ভুল না করি,” বলেন রিতা।

প্রসঙ্গত, পালাগানে রিতা বলেন, হজরত আদমকে (আ.) গন্ধম ফল খেতে নিষেধ করে শয়তানকে তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয়।

বুধবার রিতা দেওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তিনি চিকিৎসাধীন আছেন। তাঁর পক্ষে বেনারের সঙ্গে কথা বলেন স্বামী মো. আশরাফুল।

রিতা তো ক্ষমা চেয়েছে, তারপরও ক্ষমা পেল না। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির কথা সে জানতে পেরেছে। আমরা আইনজীবীর পরামর্শ অনুযায়ী চলব,” বেনারকে বলেন আশরাফুল।

বাউলদের ওপর আক্রমণ চলছেই

রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিকে সরকারের বিপরীতমুখী অবস্থানের দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন অনেকেই।

এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের শরিয়ত বয়াতি গ্রেপ্তার হন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায়।

গত মে মাসে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে বাউল সাধক আবদুল করিমের শিষ্য রণেশ ঠাকুরের গানের ঘরে আগুন দিয়ে তাঁর সংগ্রহশালা পুড়িয়ে ফেলা হয়। কেউ কেউ মনে করছেন, এ ধরনের ঘটনাগুলো একইসূত্রে গাঁথা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের শিক্ষক অনুপম হিরা মণ্ডল বেনারকে বলেন, একদিকে বাউল গানকে মহিমান্বিত করে বক্তৃতা–বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে বাউলরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। নীতি–নির্ধারকদের অবস্থান সাংঘর্ষিক।

তিনি বলেন, “এর আগে অশ্লীলতার অভিযোগ তুলে আমাদের ঐতিহ্যবাহী যাত্রা শিল্পকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে, এখন আক্রমণের শিকার হচ্ছেন বাউল শিল্পীরা।

বাংলাদেশে পশ্চিমা সংস্কৃতি কিংবা রক্ষণশীলদের সংস্কৃতি চলতে কোনো বাধা নেই, কিন্তু সকল বাধা লোকায়ত শিল্প সংস্কৃতির চর্চায় মন্তব্য করে এই লোকসাহিত্য গবেষক বলেন, “একদিকে বাউল গানকে মহিমান্বিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে বাউলদের বিকশিত হতে দেওয়া হচ্ছে না।

তবে কৌঁসুলি নজরুল ইসলামের মতে, সাইবার ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ এলেই বিচার হচ্ছে, বিষয়টা এমন না।

তিনি বলেন, “আগে আদালত অভিযোগগুলো তদন্ত করার নির্দেশ দিচ্ছে, তারপর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে।

এর আগে গত ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে শরিয়ত বয়াতিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বিশ্ব দরবারে ঐতিহ্যবাহী বাউলগান প্রশ্নবিদ্ধ হয় এমন কাজ থেকে বাউলদের বিরত থাকার আহ্বানও জানান তিনি।

ধর্মীয় ইস্যুতে উত্তপ্ত দেশ

রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হলো এমন এক সময়ে যখন ধারাবাহিকভাবে ধর্মীয় ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উত্তপ্ত।
লালমনিরহাটের পাটগ্রামে ধর্ম অবমাননার দায় চাপিয়ে গত ২৯ অক্টোবর শহিদুন্নবী জুয়েলকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।

এরপর ইসলামের মহানবীকে নিয়ে আঁকা কার্টুনের পক্ষে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর অবস্থানে ক্ষোভ প্রকাশ করে রাস্তায় নামে বিভিন্ন সংগঠন।

সেই আন্দোলন প্রশমিত না হতেই হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে সামনে আসে ভাস্কর্য ইস্যু, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য অপসারণ করতে চায় তারা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কঠোর নজরদারি করছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা গত ২৭ নভেম্বর এক ভিডিওবার্তায় প্রতিক্রিয়া দেখানো থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানান।
ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, “প্রয়োজনে ৯৯৯ এ ফোন করে তথ্যের সত্যতা যাচাই করে নিন। ধর্মীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো আপনাকে সঠিক তথ্য দেওয়ার মতো আলেম ওলামা রয়েছেন। কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করবেন না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।