বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পরীক্ষামূলক অপরাধমুক্ত এলাকা ঘোষণা
2018.03.09
কলকাতা ও ঢাকা

যৌথ সীমান্তে পরীক্ষামূলকভাবে একটি অপরাধমুক্ত এলাকা চালু করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। আন্তঃসীমান্ত চোরাচালান, সন্ত্রাস ও মানব পাচারসহ সব ধরনের অপরাধ বন্ধ করতে প্রথমবারের মতো এই উদ্যোগ নিয়েছে দুই দেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনী।
শুক্রবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলার কল্যাণীতে এক অনুষ্ঠানে যৌথভাবে এই প্রকল্পের সূচনা করেন বাংলাদেশের বিজিবির বিদায়ী মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন ও বিএসএফের মহাপরিচালক কে কে শর্মা।
“চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িতরা বিজিবি ও বিএসএফের কমন শত্রু। তাই যৌথভাবে তাদের প্রতিরোধের লড়াই হবে। এ কারণে এখন থেকে এখানে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনী যৌথভাবে টহল দেবে,” অপরাধমুক্ত এলাকার সূচনা অনুষ্ঠানে বলেন বিজিবি মহাপরিচালক।
একই অনুষ্ঠানে বিএসএফ মহাপরিচালক বলেন, “ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার মানুষের জীবনমান আরও উন্নত করতে এই অপরাধমুক্ত এলাকায় নজরদারি আরও বাড়ানো হবে।”
প্রথম অপরাধমুক্ত সীমান্ত
যৌথ সীমান্তের প্রায় সোয়া আট কিলোমিটারকে পরীক্ষামূলক অপরাধমুক্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবি। প্রকল্পটি সফল হলে আগামী দিনে সীমান্তের আরও এলাকায় এই ধরনের প্রকল্প চালু করা হবে বলে জানিয়েছে বিএসএফ।
জানা যায়, ২০১৭ সালের অক্টোবরে দু’দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক পর্যায়ের দ্বিবার্ষিক বৈঠকে যৌথভাবে অপরাধমুক্ত সীমান্ত এলাকা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মহসিন রেজা বেনারকে জানান, “ওই বৈঠকে সীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে বিজিবির বিদায়ী মহাপরিচালক মেজর জেনালের আবুল হোসেনই বিএসএফের মহাপরিচালকের কাছে ‘ক্রাইম ফ্রি জোন’ ঘোষণার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।”
“সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুক্রবার প্রথম পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে বাংলাদেশের যশোরের পুটখালি ও দৌলতপুরের এবং ভারতের কল্যাণী ও গুনারমঠের ৮.৩ কিলোমিটার সীমান্তকে অপরাধ মুক্ত এলাকা হিসেবে চালু করা হয়েছে,” বলেন তিনি।
কার্যকরভাবে অপরাধ প্রতিরোধের লক্ষ্যে এই সীমান্তের দুই পাশেই ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, সার্চ লাইট, থার্মাল ইমেজারসহ বিভিন্ন প্রকারের বর্ডার সার্ভেইল্যান্স ডিভাইস স্থাপন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবি ও বিএসএফ সূত্র।
এই এলাকায় রাতে ড্রোনের মাধ্যমেও নজরদারি করা হবে বলে জানিয়েছেন বিজিবির মহাপরিচালক।
এ প্রসঙ্গে বিএসএফের এক আধিকারিক বেনারকে বলেন, “বিএসএফ ও বিজিবি সমন্বয় রেখে যৌথ টহলদারির জন্য সীমান্তের জিরো পয়েন্টের কাছে দু’দেশের দুটি বর্ডার লিয়াজোঁ পোস্ট তৈরি করা হয়েছে। অপরাধীদের সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য আদান প্রদান করাও হবে।”
“একইসঙ্গে সীমান্তে অপরাধ প্রতিরোধে স্থানীয় জনসাধারণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা হচ্ছে,” বেনারকে বলেন মহসিন রেজা।
এক বিবৃতিতে বিএসএফ’র আধিকারিক রবিরঞ্জন জানান, “সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষ, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়েই অপরাধমুক্ত এলাকা গড়ে তোলার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে।”
প্রসঙ্গত, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সাথে রয়েছে ২,২১৬ কিলোমিটার সীমান্ত। এছাড়া ত্রিপুরার সাথে ৮৫৬, মেঘালয়ের সাথে ৪৪৩, আসামের সাথে ২৬৩ ও মিজোরামের সাথে রয়েছে ৩১৮ কিলোমিটার সীমান্ত।
এই দীর্ঘ সীমান্তের দুই তৃতীয়াংশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হলেও বহু দুর্গম ও নদীযুক্ত সীমান্ত রয়েছে যেখানে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় নি।
সীমান্ত অপরাধের স্বর্গরাজ্য
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত বহুদিন ধরেই চোরাচালানোর স্বর্গরাজ্য বলে মনে করেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষ। সীমান্ত দিয়ে দু’দেশের মধ্যে সব ধরনের পণ্যের চোরাচালান হলেও গরু, সোনা, অস্ত্র এবং জাল নোট পাচারের ঘটনা সাম্প্রতিক কালে অনেক বেড়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য হীরক বসু বেনারকে বলেন, “সীমান্তে চোরাচালানই শুধু নয়, নারী ও শিশু পাচার, অনুপ্রবেশ, সন্ত্রাসীদের অবৈধ যাতায়াতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বিশাল একটি বাহিনী।”
বিএসএফের কিছু সদস্য সীমান্তে দুর্নীতিতে জড়িত বলে কয়েকদিন আগে কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে স্বীকার করেছেন বিএসএফের মহাপরিচালক।
তবে সীমান্তে প্রহরারত এক জওয়ান বেনারকে বলেন, “প্যালেট গানের মতো অস্ত্র নিয়ে বিশাল অপরাধীচক্রকে মোকাবিলা করা রীতিমত দুরূহ কাজ। তবে কড়া নজরদারির ফলে গরু পাচার অনেকটাই কমানো সম্ভব হয়েছে।”
পরীক্ষামূলক অপরাধমুক্ত সীমান্ত প্রকল্প সম্পর্কে এক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির সভাপতি অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “অপরাধ দমনের জন্য এটা অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। এতে সীমান্তে অবৈধ সন্ত্রাস, অপরাধ, মানবপাচার, আনঅথরাইজড ট্রেডিং কন্ট্রোল করা সম্ভব হবে।”
“সীমান্ত এলাকাকে অপরাধমুক্ত করার সঙ্গে যুক্ত সকলকে সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। সেই সঙ্গে সীমান্ত এলাকার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। তবেই সাফল্য আসতে পারে,” বেনারকে বলেন কল্যাণীর বিধায়ক (এমএলএ) রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস।