ভারতে কারাগার থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে প্রথম সংবাদপত্র
2017.03.29
কলকাতা

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি কারাগার থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে ব্রড শিট আকারের একটি সংবাদপত্র। আগামী ১ বৈশাখ থেকে নিয়মিত এই সাপ্তাহিক সংবাদপত্রটি প্রকাশিত হবে বলে জানিয়েছে কারাগার সূত্র।
মেদিনীপুর শহরের মিদনাপুর কেন্দ্রীয় কারাগার তথা সংশোধনাগারে এই পত্রিকার আয়োজনে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বন্দীরা নিজেরাই প্রকাশ করবে পত্রিকাটি।
এটাই ভারতে প্রথম কোনো কারাগারে পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ বলে দাবি করেছেন কারা কর্তৃপক্ষ। যা ইতিমধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
পত্রিকাটির মাধ্যমে মত প্রকাশ করার সুযোগের পাশাপাশি বন্দীরা দ্রুত সুস্থ সমাজে ফিরে আসার পথও খুঁজে পাবেন বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নতুন সংবাদপত্র নিয়ে বন্দীরা প্রবল উৎসাহিত। ব্যাপারটি অন্য রকম হওয়ায় কাগজের প্রথম সংখ্যা দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন অনেকেই।
মিদনাপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপারিনটেনডেন্ট দেবাশীষ চক্রবর্তী বেনারকে জানান, ব্রড শিট আকারে চার পৃষ্ঠার এই পত্রিকাটি সম্পাদনার জন্য বন্দীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ১৬ সদস্যের সম্পাদকমণ্ডলী তৈরি করেছে। তাঁরা সকলেই সাজাপ্রাপ্ত বন্দী।
তিনি বলেন, “আমরা যে রকম খবরের কাগজ দেখতে অভ্যস্ত, কাগজটি তেমনিই হবে।”
জানা যায়, বন্দীদের মধ্য থেকেই সাংবাদিক চেয়ে বুধবার কারাগারে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা অন্তত উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। আবেদনপত্রের সঙ্গে যে কোনো বিষয়ের ওপরে ৫০-৬০ শব্দে সাবলীল এবং নির্ভুল বাংলায় একটি লেখা জমা দিতে বলা হয়।
ইতিমধ্যেই ১০-১২ জন সাংবাদিক হওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। আরও কিছু আবেদনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। আর লিখতে চাইলে সম্পাদকমণ্ডলীর কাছে আবেদনও জানানো যাবে।
এ প্রসঙ্গে কারা সুপারিনটেনডেন্ট দেবাশীষ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, “কারা কর্তৃপক্ষ টেকনিক্যাল সহায়তা ছাড়া আর কোনো ভাবেই এর সঙ্গে যুক্ত থাকছে না। যা করবে সব বন্দীরাই করবে।”
কারাগারের ওয়েলফেয়ার অফিসার কর্ণ দেব গোস্বামী সাংবাদিকদের বলেন, “কারাগারে একাধিক কম্পিউটার রয়েছে। কাগজ প্রকাশনার ক্ষেত্রে বন্দীরা এই কম্পিউটারই ব্যবহার করবেন।”
কর্তৃপক্ষ জানায়, মিদনাপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বর্তমানে প্রায় ১৪০০ বন্দী রয়েছেন। এদের মধ্যে মহিলারাও রয়েছেন। তবে সংবাদপত্র প্রকাশের সঙ্গে আপাতত মহিলাদের যুক্ত করা হচ্ছে না।
কারাগারে খোলা হাওয়া
বন্দীরা যে সাপ্তাহিক সংবাদপত্রটি প্রকাশ করতে চলেছে সেটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘খোলা হাওয়া’।
বন্দীদের জীবনের একঘেয়েমি কাটানো খোলা হাওয়া তৈরির উদ্দেশ্য জানিয়ে কারাগারের সুপার দেবাশিস চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেন, “বন্দীদের অভাব-অভিযোগের কথা কাগজে জায়গা পাবে। স্বাভাবিকভাবে যে বিষয়গুলি আমাদের চোখে পড়ে না, তাঁদের লেখা থেকে সে সব জানতে পারব। সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপও করা যাবে।”
তাঁর মতে, এই খবরের কাগজ আবাসিকদের কাছে একটা প্ল্যাটফর্ম। এতে জেলের নানা খবরের পাশাপাশি বন্দীদের সমস্যার কথা, তাঁদের লেখা কবিতা, কার্টুন, সবই জায়গা পাবে।
আপাতত বিনা মূল্যে পত্রিকাটি মিদনাপুর কারাগারের বন্দীদের মধ্যেই বিতরণ করা হবে বলে জানান দেবাশিস চক্রবর্তী।
এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা। এ প্রসঙ্গে বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ মাসুমের সম্পাদক কিরীটী রায় বেনারকে বলেন, “বহুদিন আগেই এই উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। তবে এত দিনে যে সরকার অনুমতি দিয়েছেন সেটা ভালো লক্ষণ।”
তিনি বলেন, “বন্দীরা এই সংবাদপত্রে নিজেদের কথা বলতে পারবেন। তাঁদের মত প্রকাশ করার সুযোগ পাবেন। এর ফলে তাঁরা দ্রুত সুস্থ সমাজে ফিরে আসার পথও খুঁজে পাবেন।”
তবে পত্রিকাটি সেন্সরশিপ না করানোর পক্ষে মত দিয়ে তিনি বলেন, “মনে রাখতে হবে একজন নাগরিকের বাইরেও যেমন মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে, তেমনি কারাগারের মধ্যেও সংবিধানের ১৯ ধারা অনুযায়ী মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে সমানভাবে।”
কারাগার এখন সংশোধনাগার
পশ্চিমবঙ্গে কারাগার এখন সংশোধনাগার। ১৯৯২ সালে সংশোধিত সংশ্লিষ্ট আইনটি ১৯৯৭ সালে কার্যকর করা হয়েছে। এই আইনে বন্দীদের বিনোদন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সব ধরনের কাজে উৎসাহিত করার কথা বলা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে ৫৯টি ছোট-বড় মিলিয়ে কারাগার তথা সংশোধনাগার রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মুক্ত কারাগারও। গত বছরের মে পর্যন্ত এই সব কারাগারে বন্দী রয়েছেন ২১ হাজার ৫৩৬ জন।
সাবেক জেল সুপারিনটেনডেন্ট বিদ্যুৎ কুমার রায় বেনারকে বলেছেন, “সংশোধনাগারের ধারণার সঙ্গে সংগতি রেখে খবরের কাগজের আকারে পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে খুব ভালো প্রচেষ্টা। অতীতে অবশ্য বন্দীরা নিয়মিত দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ করেছেন।”
বন্দীদের স্বনির্ভর করতে কারাগারের নানা ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বন্দীদের মানসিক পরিবর্তনে পত্রিকা প্রকাশও বিশেষ প্রভাব রাখবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমার কর্মজীবনে আমি বহু বন্দীকে দেখেছি যারা প্রতিভাবান শুধু নয়, সৃষ্টি করার ক্ষমতাও তাদের অসাধারণ।”
মিদনাপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে বন্দীরা ক্যানটিন চালাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তারা মুনাফাও করছেন। সেই অর্থ জমা থাকছে। তার একটি অংশ দিয়েই আপাতত পত্রিকা প্রকাশ করা হবে বলে কারাগার সূত্রে জানা গেছে।