এক জঙ্গি-মাতার জঙ্গিবাদ বিরোধী মিশন
2017.02.14

সন্তান জঙ্গিবাদে জড়ালে অভিভাবকরা যেখানে লজ্জা ও কষ্টে নিজেদের গুটিয়ে রাখেন, সেখানে এক নিহত জঙ্গির মা ঘুরে বেড়াচ্ছেন জঙ্গিবাদ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে অন্য মায়েদের সচেতন করতে।
“আমি যখন, যেখানে যাই শুধু সন্তানহারা মায়ের যে কষ্ট সেটাই বলি। মা আর ছেলের যে ভালবাসা, সেখানে অন্য কোনো কিছুর ঠাঁই নেই। এ-ই আমার শক্তি,” বলেন সালিহা।
তিউনিসীয় বংশোদ্ভূত বেলজিয়ামের নাগরিক সালিহা বেন আলী নিহত এক আইএস জঙ্গির মা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তার সাড়ে আঠারো বছরের ছেলে সাবরি বেন আলী সিরিয়ায় আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যায়।
মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে ‘ক্যাম্পেইন টু কাউন্টার ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম’ অনুষ্ঠানে নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের কাছে নিজের অভিজ্ঞতা বলেন সালিহা বেন আলী। যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ও ইনোভেশন ফর ওয়েলবিং ফাউন্ডেশন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক। তিনি প্রশ্ন করেন, “কিশোর তরুণেরা জঙ্গিবাদে জড়ানোর পর শনাক্ত হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে তারা জঙ্গিবাদে জড়াবে কেন?”
এই প্রশ্নের কিছুটা উত্তর মেলে নিজের ছেলে সম্পর্কে সালিহার অভিজ্ঞতায়, “সাবরি ছিল ভীষণ কৌতূহলী। তার মনে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেত। ভুল সময়ে সে ভুল মানুষের খপ্পরে পড়ে গিয়েছিল। আর ফেরেনি।”
সাবরির মায়ের এই অভিজ্ঞতাকে যুক্তি দিয়ে সমর্থন করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মেখলা সরকার। তিনি বলেন “যে বয়সে ছেলেমেয়েরা জঙ্গিবাদে জড়ায়, সে বয়সে তাদের কৌতূহল বেশি থাকে। তারা নিজেদের বীরত্ব জাহির করতে চায়।”
এই বয়সে ছেলেমেয়েদের বেশি সময় দেবার উপর জোর দেন তিনি, “বাবা মা ও পরিবারের অন্যদের উচিত তারা যা বলছে, যা ভাবছে তা ধৈর্য্য ধরে শোনা, সময় দেওয়া", বলেন মেখলা সরকার।
মায়ের মুখে সাবরির গল্প
বেলজিয়ামের সাবরি বেন আলীর জীবন ছিল আর সব কিশোর-তরুণদের মতোই। আড্ডা-গল্প-গানে ভরপুর। কিন্তু হঠাৎ করে ছেলেটা বদলে যেতে শুরু করল। নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিল। শুরু করল ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি।
তারপর একদিন উধাও।
ওই মায়ের ভাষ্য—যে সময়টার কথা বলছি, সে সময় সাবরি খুব অনিশ্চয়তায় ভুগছিল। পড়ালেখা বন্ধ রেখে চাকরিতে ঢুকতে চাইছিল। কিন্তু তিনটা ভাষা জেনেও সে বেলজিয়ামে একটা চাকরি পাচ্ছিল না।
সালিহা বলছিলেন, তখনই সাবরি ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তার মনে হচ্ছিল সে বৈষম্যের শিকার। মুসলিমরা বৈষম্যের স্বীকার। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করছে না।
“একদিন সে মসজিদের ইমামের সঙ্গে দেখা করে। ইমাম বললেন, সাবরি নামাজ পড়তে আসতে পারে। তবে ধর্মীয় কোনো আলোচনার সময় বা সুযোগ তাঁর নেই।” জানান সালিহা।
মায়ের ভাষ্য, ঠিক ওই সময়ে সাবরিকে কিছু লোক টার্গেট করে। ওরাই সাবরিকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করে।
“ওরা ধর্মের নামে শুধু বিদ্বেষ ছড়াত। সবকিছুতে ষড়যন্ত্র দেখতে পেত। এক সময়ে ওরা সাবরিকে বোঝাতে সক্ষম হলো, জিহাদের জন্য সে মনোনীত হয়েছে,” সালিহা বলেন।
ছেলেহারা এই মায়ের ক্ষোভ মসজিদের ইমামদের ওপর। তারা যদি সাবরিকে সময় দিতেন, তাহলে সে পথভ্রষ্ট হতো না—এখনো তাই ভাবেন।
২০১৩ সালের আগস্টে বেলজিয়াম থেকে সিরিয়া যাওয়ার পর আর কখনো ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সালিহা বেন আলী বলেন, ফেসবুকে ছেলে যোগাযোগ করেছিল।
তিনি তাকে ফিরে আসার অনুরোধ করলে সাবরি জানায়, সে এমন জায়গায় আছে যেখানে তাকে নজরদারির মধ্যে থাকতে হয়।
ওটাই ছিল ছেলের সাথে তার শেষ যোগাযোগ।
সাবরি বাড়ি ছাড়ার তিন মাস পর অপরিচিত কেউ সিরিয়া থেকে সাবরির বাবাকে ফোন করে জানায় যে, সাবরি এইমাত্র মারা গেছে, জানান সাবরির মা।
আর কারো যেনে এই পরিণতি না হয়
সাবরি মারা যাবার সংবাদ শোনার পর তার মা সালিহা বেন আলী কোথায় যাবেন, কার কাছে যাবেন ভেবে পান না।
এক সময় সিদ্ধান্ত নেন, তিনি মুখ খুলবেন। সাবরির মতো আর কোনো ছেলে যেন ধর্মের নামে ভুল পথে পা না বাড়ায় সে জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন সালিহা আলী।
সালিহা তখন থেকে কাজ করে চলেছেন। তিনিই প্রথম ইউরোপীয় নারী যিনি স্কুল-কলেজে যাচ্ছেন। জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে আছে—এমন পরিবারগুলোকে উদ্বুদ্ধ করছেন। এরই অংশ হিসেবে এখন তিনি ঢাকায়।
সাবরির বদলে যাওয়ার গল্প শুনিয়ে তিনি অন্য মায়েদেরও সচেতন করতে চান।
আগামী শুক্রবার পর্যন্ত সালিহা বাংলাদেশে থাকবেন। এই সময় সেমিনার ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। পাশাপাশি, যেসব পরিবারের সন্তানরা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে বা মারা গেছে তাদের সাথেও কথা বলবেন তিনি।