ঈদের আগের দিন আইএসের কথিত ভিডিও বার্তায় হামলার হুমকি
2016.07.06
বেনার নিউজ স্টাফ

এক মাস রোজা রাখার পর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় যখন পবিত্র ঈদ পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ঠিক তার একদিন আগে গতকাল বুধবার একটি নতুন ভিডিও প্রকাশ করেছে ইসলামিক স্টেট—আইএস। এই ভিডিওর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে মানুষের মধ্যে।
তবে পুলিশ নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ ইন্টারনেটে ভিডিও প্রকাশ বা শেয়ারের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক তৎপরতা নজরদারি করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের ভিডিও প্রকাশের দাবি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
পুলিশের একজন উপ মহাপরিদর্শকের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকালই জানানো হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউবে আইএস কিংবা জঙ্গিবাদের সমর্থনে কোনো ধরনের ভিডিও, ছবি, কোনো বার্তা আপলোড বা শেয়ার করলে কিংবা মন্তব্য করলে বা লাইক দিলে তা হবে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
“এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ সকলকে অনুরোধ জানাচ্ছে,” বলা হয়েছে পুলিশের বার্তায়।
বুধবার দিনভর ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে আইএসের নতুন ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পুলিশ সতর্ক করার পর বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যম ও ব্যক্তিগত আইডি থেকে ভিডিওটি নামিয়ে বা মুছে ফেলা হয়।
নতুন ভিডিওতে গুলশানে হামলাকারীদের প্রশংসা করে বাংলাদেশে আরও জঙ্গি হামলার হুমকি দেওয়া হয়।
গত ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলা হয়। ওই ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা, ১৭ বিদেশি, দুজন বাংলাদেশের নাগরিক, একজন দ্বৈত নাগরিকসহ মোট ২২ জন নিহত হন।
হামলাকারি পাঁচজনসহ ছয়জন সেনা নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে নিহত হয়।
আগামী ২৪ আগস্টের মধ্যে ওই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত। গতকাল বুধবার পুলিশ ওই মামলার নথি আদালতে উপস্থাপন করলে মহানগর হাকিম স্নিগ্ধা রাণী চক্রবর্তী এই নির্দেশ দেন।
ওই ঘটনায় গত সোমবার রাতে গুলশান থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা করা হয়েছে। এতে ওই ঘটনায় নিহত ছয় হামলাকারীসহ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়।
নৃশংস ওই ঘটনার রেশ না কাটতেই নতুন করে জঙ্গি হুমকির ঘটনায় সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ, পুলিশও সতর্ক। বৃহস্পতিবার ঈদ উপলক্ষে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ঈদগাহসহ দেশের লাখ লাখ ঈদের জামাতস্থলে জায়নামাজ ছাড়া কোনো ধরনের ব্যাগ বা বস্তু না নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে সাইট ইন্টেলিজেন্স একটি টুইটে কথিত বাংলাদেশি আইএস যোদ্ধার ভিডিও বার্তার কথা জানায়। সাইটের দাবি অনুযায়ী, বার্তায় উল্লেখিত ওই তিন বাংলাদেশি সিরিয়ার রাকায় জঙ্গি সংগঠন আইএসের যোদ্ধা।
এ ধরণের খবর প্রকাশের বিষয়ে পুলিশের উপ মহাপরিদর্শক শহীদুর রহমান বেনারকে বলেন, “খবর প্রকাশে পুলিশের আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা অনুরোধ করব সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে যেন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এমন কিছু যাতে না করা হয়, যা জঙ্গিদের পক্ষে যায়।”
টুইটে তিন জঙ্গির ছবি দেওয়া হয়েছে। তিনজনের মধ্যে একজনের মুখ কাপড়ে ঢাকা। অন্য দুজনের চেহারা স্পষ্ট দেখা যায়। এদের একজনকে আবু ঈসা আল বাঙালি ও আরেকজনকে আবু খালিদ আল বাঙালি নামে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় জনের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বার্তাটি ছড়িয়ে পড়লেও কোনো নিরপেক্ষ সূত্র থেকে ওই ভিডিও বার্তার সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
আইএস এর পতাকা সম্বলিত ওই ভিডিওতে দুই তরুণকে বাংলায় এবং একজন তরুণকে বাংলা ও ইংরেজিতে কথা বলতে দেখা যায়। ভিডিওতে আইএসের বার্তা ও মতবাদ প্রচারে আরবির সঙ্গে বাংলা অনুবাদও দেওয়া হয়েছে।
তিন তরুণের বক্তব্যের বরাত দিয়ে সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপের প্রধান রিটা কাটজ গুলশানের ঘটনার দিকে ইংগিত করে মঙ্গলবার এক টুইটে লিখেন “ওটা ঝলক মাত্র... বারবার ঘটবে।”
ওই ভিডিও এবং তিন হুমকিদাতার ছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে; চেহারার মিলের কারণে কেউ কেউ তাদের সম্ভাব্য পরিচয়ও বলছেন।
পুলিশ বলছে, ওই তিন যুবকের পরিচয় সম্পর্কে এখনো তারা নিশ্চিত হতে পারেনি।
ভিডিও বার্তায় দেখা যায়, যুবকেরা বাংলাদেশ সরকার ও তাঁদের ভাষায় ‘ক্রুসেডারদের’ সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, গণতন্ত্র একটি ভ্রান্ত মতবাদ।
ভিডিওতে দেখা যায়, রাতে একটি ব্যস্ত রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে। তবে ভিডিও দেখে জায়গাটি কোথায় সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়নি।
কথিত প্রথম জঙ্গির কিছু কথা
“বাংলাদেশের তাগুদ সরকার, এদের কর্মচারী এবং এদের সমর্থকদের উদ্দেশ্যে, আমি তোমাদের সবাইকে প্রশ্ন করতে চাই যে, কেমন করে তোমরা ডেমোক্রেসিকে (গণতন্ত্র) সাপোর্ট কর? ডেমোক্রেসি নামক এই শিরকি মতবাদকে কীভাবে তোমরা সাপোর্ট কর?” প্রশ্ন রেখেছে কথিত ওই জঙ্গি।
তার বক্তব্য-“তোমরা কি জান না, ডেমোক্রেসি হচ্ছে সেই মতবাদ, যে মতবাদ বলে ক্ষমতা এবং আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা মানুষের হাতে। যেখানে আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলে দিয়েছেন যে, আইন একমাত্র আল্লাহর।”
“আমি বাংলাদেশের তাগুদ সরকারের উদ্দেশে বলতে চাই, যে জিহাদ আজ বাংলাদেশে এসেছে, যে জিহাদ আজ তোমরা প্রত্যক্ষ করছ, এ রকম জিহাদ তোমরা এর আগে কখনো দেখনি। এ জিহাদ সেই জিহাদ, সেই খেলাফত জিহাদ, যার প্রতিশ্রুতি রসুলুল্লাহ (সাঃ) করে গিয়েছিলেন। সুতরাং তোমরা কখনই এ জিহাদকে বন্ধ করতে পারবে না,” উল্লেখ করেছে ওই তরুণ।
তার মতে, “যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা জয়ী হই, তোমরা পরাজিত হও এবং সারা দুনিয়ার বুকে খেলাফত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠিত হয়, একে তোমরা রুখতে পারবে না। সুতরাং সেই চেষ্টা করে লাভ নেই।”
“সর্বশেষ আমি ক্রুসেডারদের প্রতি এই বার্তাটি দিতে চাই। খ্রীষ্টান, ইহুদি ক্রুসেডার এবং তাদের সমর্থকদের প্রতি যখন শেখ আদনানি আমাদের আদেশ করেছেন তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য, তখন তিনি কৌতুক করেননি। আমরা শেষ পর্যন্ত তোমাদের সঙ্গে লড়ে যাব। হয় আমরা জয়ী হব, নইলে শাহদাৎ বরণ করব। আমাদের হারানোর কিছু নেই,” উল্লেখ করেছে ওই বিভ্রান্ত যুবক।
তার আরও বক্তব্য হচ্ছে, “তোমরা বাংলাদেশে যা দেখেছে তা এক ঝলক ছাড়া আর কিছু নয়। এটা পুণরাবৃত্তি হতে থাকবে যতক্ষণ না তোমরা পরাজিত হও, আর আমরা বিজয়ী হই এবং পৃথিবীর কোনায় কোনায় শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহর অনুমতিক্রমে তোমরা তা কখনই বন্ধ করতে সক্ষম হবে না।”
দ্বিতীয় জঙ্গির বক্তব্য
“আমরা যদি আজ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাকাই, তবে এই ভূমিতে সমস্ত সরকার আল্লাহ সুবহানাল্লাহ তায়ালার নাযিলকৃত বিধানকে মানবরচিত আইন দ্বারা পরিবর্তন করেছে। যার ফলে তারা তাগুদ হয়ে যায়, কাফের হয়ে যায়। আর তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা ফরজে আইন হয়ে যায়,” জানায় বিভ্রান্ত ওই যুবক।
তার বক্তব্য হচ্ছে, “আন্তর্জাতিক ক্রুসেডারদের কোয়ালিশন যখন ইরাক এবং লিবিয়ার ভূমিতে বিমান হামলায় শত শত নিরীহ মুসলিম নারী, পুরুষ এবং শিশুদের হত্যা করে তখন এই মর্মান্তিক দৃশ্য আমাদের মুজাহিদীন ভাইবোনদের বেদনা দেয়। আর তাই মুসলিম ভাইবোনদের রক্তের প্রতিশোধ নিতে তারা ক্রুসেডরদেরকে যেখানেই পাবে, সেখানেই কতল করে ছাড়বে।”
তৃতীয় জঙ্গির বক্তব্য
বিভ্রান্ত আরেক তরুণ বলেছে, “রমজানের এই বরকতময় সময়ে খিলাফতের ভাইদের এত চমৎকার একটি অপারেশনের খবর পড়ে আমি আজ সত্যি অভিভূত। ভাইরা, আপনারা বাংলাদেশে যে কাজটি করেছেন, এরকম কাজ বাংলাদেশে আর কখনো হয়নি। আপনারা আজ বাংলাদেশে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।”
ওরা ইসলামের অপব্যাখ্যা করেছে
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরামের সভাপতি মুফতি এনায়েত উল্লাহ বেনারকে বলেন, “ইসলাম কখনো গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে নির্বিচারে মানুষ হত্যাকে সমর্থন করে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের অপব্যাখ্যা করে, যারা ইসলামের নামে যারা মানুষ হত্যা করছে, তারা ইসলামের ক্ষতিই করছে।”
তিনি মনে করেন, এসব তরুণকে ‘মগজধোলাই’ করে কথিত জিহাদের নামে মানুষ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও মসজিদের ইমাম, সাংবাদিক, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং পরিবারের সদস্যদের কার্যকর ভূমিকার মাধ্যমে তরুণদের রক্ষা করতে হবে, বিভ্রান্ত তরুণদের সঠিকপথে ফিরিয়ে আনতে হবে।