গুলশান হামলার অস্ত্র সরবরাহকারী মিজানও পুলিশের কবজায়
2017.03.01

গুলশানের হলি আর্টিজানে রক্তাক্ত হামলায় অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগে মিজান ওরফে বড় মিজান (৬০) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ইউনিট। ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার মুখপাত্র মাসুদুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
“মঙ্গলবার রাতে বনানী রেল ক্রসিং এলাকায় একটি বাস থেকে মিজানকে গ্রেপ্তার করা হয়। হলি আর্টিজানে হামলার জন্য ওই ব্যক্তি বসুন্ধরায় তানভীর কাদেরীর বাসায় অস্ত্র পৌঁছে দিয়েছিল,” বেনারকে বলেন মাসুদুর রহমান।
পুলিশের ওই মুখপাত্র আরও বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা মিজান আম বোঝাই করা গাড়িতে অস্ত্রগুলো ঢাকায় এনেছিল।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে তানভীর কাদেরীর আজিমপুরের বাসায় পুলিশ অভিযান চালালে সে আত্মহত্যা করে। তার স্ত্রী সেভ দ্য চিল্ড্রেনের সাবেক কর্মকর্তা আবেদাতুল ফাতেমা আশা ও এক ছেলে এখন কারাগারে রয়েছে। গত ডিসেম্বরে আশকোনায় পুলিশি অভিযানে অপর ছেলে নিহত হয়।
বড় মিজানকে গ্রেপ্তারের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের নভেম্বরে চারজনের একটি দলকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, হলি আর্টিজানের হামলায় মিজানের সম্পৃক্ততা ছিল।
কে এই বড় মিজান?
বড় মিজান এক সময়ে জুনুদ আল তাওহীদ নামে একটি জঙ্গি সংগঠনের সামরিক কমান্ডার ছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ এলাকায় সংগঠনের নেতৃস্থানীয় পদে ছিল সে। পরে সে তামিম চৌধুরীর বায়াৎ (শিষ্যত্ব) নেয়।
গতকাল পুলিশ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মিজান চাঁপাইনবাবগঞ্জের সীমান্তবর্তী এলাকা শিবগঞ্জে অস্ত্র চোরাচালানের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল। অস্ত্র, ডেটোনেটর ও জেল—সবকিছু সরবরাহের মূল দায়িত্ব পালন করছিল বড় মিজান।
ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, গত বছরের ২ নভেম্বর দারুস সালাম থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। ওই মামলারও অন্যতম আসামি সে। হলি আর্টিজানে হামলায় অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগে দায়ের হওয়া এই মামলায় বড় মিজান ছাড়া আরও চারজনের নাম ছিল।
পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার ওই চারজন হলো; মো. সেলিম মিয়া (৪৫), মো. আবু তাহের (৩৭), মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান (৩৪) ও তৌফিকুল ইসলাম ওরফে ডা. তৌফিক (৩২)।
অস্ত্র আসে ভারত থেকে
পুলিশের তথ্য হচ্ছে, হলি আর্টিজানে হামলায় জঙ্গিরা একে–২২ রাইফেল, পিস্তল, চাপাতি ও গ্রেনেড ব্যবহার করে। একে-২২ স্বল্প দূরত্বে গুলি করার কাজে ব্যবহার হয়। সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসীদের কাছে খুব বেশি জনপ্রিয় না হলেও, সম্ভবত কম প্রশিক্ষিতরা সহজে ব্যবহার করতে পারবে বলে এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল।
“গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলায় যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো ভারতে তৈরি। ওপার থেকে কারা এই অস্ত্র এপারে পৌঁছায় সেই তথ্য আমাদের হাতে আছে। সে অনুযায়ী কাজও চলছে,” মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন।
তবে তদন্তের স্বার্থে ওপাশ থেকে কারা এই অস্ত্র জোগান দিয়েছে, সে সম্পর্কে মনিরুল কিছু বলতে অপারগতা জানান।
এর আগে ভারতীয় গণমাধ্যমে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের পর জানানো হয়েছিল, গুলশানের হলি আর্টিজানে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো ভারতে তৈরি।
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেখানকার সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, অস্ত্রগুলো পশ্চিমবঙ্গের মালদহে তৈরি। বিহারের মুঙ্গেরের একদল কারিগরকে পাকিস্তানি কারিগরেরা অস্ত্র বানানোর প্রশিক্ষণ দেয়। ওই কারিগরেরা ছিল পাকিস্তানের পেশোয়ার ও কোহাট এলাকায় দারা আদম খেল সম্প্রদায়ের। ধারণা করা হয়, তালেবানদেরও অস্ত্র সরবরাহ করে থাকে তারা।
উল্লেখ্য, ভারতের মালদহ বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাছে অবস্থিত।
অস্ত্র চোরাচালানের পথ বন্ধ করতে হবে
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অঞ্চলে অস্ত্র চোরাচালান খুব সাধারণ ঘটনা। নিরাপত্তা বাহিনী থেকেও অস্ত্র বাইরে চলে যায়।
তাঁরা বলছেন, চীনের সামরিক বাহিনীর ব্যবহার করা অস্ত্র বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে এমন উদাহরণও আছে। ভারত থেকেও বাংলাদেশে অস্ত্র ঢোকে। এগুলো বন্ধে স্ব স্ব দেশের বাহিনীগুলোকে আন্তরিক হতে হবে।
“সবচেয়ে জরুরি হলো আন্তরিকতা, আস্থা ও বিশ্বাস। ভারত চাইলে আমি মনে করি বাংলাদেশের ভেতরে অস্ত্র আসা বন্ধ করা যায়। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী আরেকটু তৎপর হলে হয়তো অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঠেকানো যেত,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান।
এ দিকে পুলিশ সদর দপ্তরে কাউন্টার টেররিজমের ফোকাল পয়েন্ট ও সহকারী মহাপরিদর্শক মনিরুজ্জামান বলেন, তাঁরা জঙ্গিবাদ দমনে ভারতের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। দুই দেশের মধ্যে এ বিষয়ে পারষ্পরিক সহযোহিতা রয়েছে।
“খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের ঘটনায় বর্ধমানের মুসাকে গ্রেপ্তারের পর আমরা ভারতে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি। ভারতে পালিয়ে থাকা নব্য জেএমবির সদস্যদের সম্পর্কে আমরা তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি,” বেনারকে বলেন মনিরুজ্জামান।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের অতিরিক্ত উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, বড় মিজানকে আমরা ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আরজি জানিয়েছি আদালতে। রোববার রিমান্ড আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সাইফুল বলেন, হলি আর্টিজানের ঘটনায় বড় মিজানসহ শীর্ষপর্যায়ের তিনজন জেলে আছে। বাকিরা হচ্ছে; জাহাঙ্গীর ও রাজীব গান্ধী।
উল্লেখ্য, গত ১ জুলাই রাত রাত ৮টা ৪২ মিনিটে গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় পাঁচ জঙ্গি। রেস্তোরাঁর ভেতরে থাকা দেশি-বিদেশি ২০ নাগরিককে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা। জঙ্গিদের বোমায় নিহত হন পুলিশের দুজন কর্মকর্তা।
পরদিন সকালে সেনা নেতৃত্বে পরিচালিত যৌথ অভিযানের মধ্য দিয়ে জঙ্গিদের ১২ ঘণ্টার জিম্মি সংকটের অবসান হয়। ওই অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। আহত হন র্যাব ও পুলিশের মোট ৪১ জন।