বাংলাদেশের আইনে বৈবাহিক ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত নয়
2017.04.17
ঢাকা

বাংলাদেশের ১০ জন পুরুষের পাঁচজনই স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনকে (মেরিটাল রেপ) বৈধ মনে করেন। পাশাপাশি দেশের বিদ্যমান আইনে এ ধরনের বৈবাহিক ধর্ষণ এখনো অপরাধ হিসেবে গণ্য নয়।
আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন অক্সফামের করা নারী ও বালিকাদের ওপর সহিসংতা বিষয়ক সাম্প্রতিক এক জরিপে মেরিটাল রেপ বা বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টি প্রকাশ পেয়েছে। এতে আরও দেখা গেছে, শিক্ষাগত যোগ্যতার শ্রেণিভেদে সকল পুরুষ মনে করেন যে, স্ত্রীদের চড়-থাপ্পড় মারা ও পেটানোর অধিকার স্বামীদের রয়েছে।
স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে গেলে স্ত্রীরা কী করতে পারেন—এমন প্রশ্নের জবাবে শতকরা ৯১ ভাগ পুরুষ উত্তরদাতা বলেছেন, নারীরা এ ক্ষেত্রে কিছুই করতে পারে না। জরিপে এ জাতীয় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনকে ‘মেরিটাল রেপ’ বা বৈবাহিক ধর্ষণ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সরকারের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেক্টরাল কর্মসূচির প্রধান ও সরকারের উপ-সচিব ড. আবুল হোসেন বেনার নিউজকে বলেন, “বাংলাদেশের প্রচলিত আইনগুলোতে ম্যারিটাল রেপ নিয়ে একটি শব্দও নেই। কারণ, স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন যাকে পশ্চিমা ধারণায় ‘মেরিটাল রেপ’ বলা হয়, তা আদালতে প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব।”
ম্যারিটাল রেপকে শাস্তি হিসাবে গণ্য করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই বলেও জানান আবুল হোসেন।
এখন পর্যন্ত বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা না হলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন বিষয়টিকে বাংলাদেশের আইনে অন্তুর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির প্রধান সালমা আলী বেনারনিউজকে বলেন, “এখনো মেরিটাল রেপকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয় না। তবে সরকারের উচিত এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা।”
“একজন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি তাকে শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করা হয় তাহলে তা রেপ; সেটা স্বামী বা যেই হোক না কেন। কারণ মেয়েটিতো নির্যাতনের শিকার হচ্ছে,” বেনারকে বলেন নারী প্রগতির প্রধান রোকেয়া কবির।
“আমরা মনে করি মেরিটাল রেপ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হওয়া উচিত,” জানান রোকেয়া।
তবে ‘প্রয়োজনে’ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মেরিটাল রেপ’কে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করে আইন সংশোধনের সুপারিশ করতে পারে বলে জানিয়েছেন কমিটির সভাপতি রেবেকা মোমিন।
তিনি বেনারকে বলেন, “নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন এক ধরনের নির্যাতন। সরকার চাইলে এই নির্যাতনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করতে পারে।”
অক্সফামের প্রতিবেদনটির সাথে একমত পোষণ করে রেবেকা মোমিন বলেন, “শতকরা ৫০ ভাগ কেন, গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৭০ ভাগ নারী পুরুষের ইচ্ছা অনুযায়ী শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে।”
“তবে শহরগুলোতে এই হার কম। নারীরা আস্তে আস্তে সচেতন হয়ে উঠছে; পুরুষের এহেন আচরণের প্রতিবাদ করছে,” তিনি যোগ করেন।
দাম্পত্য সহিংসতা বনাম সম্পর্ক
প্রতিবেদন মতে, দেশের নারী নেত্রী, শিক্ষক এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ নারীদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে থাকলেও তাদের অনেকেই স্ত্রীদের মারধর করাকে সহিংসতা বলে মনে করেন না। বরং এটিকে তারা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অংশ হিসেবে গণ্য করেন।
স্বামী যদি স্ত্রীকে মারধর করে, তবে তাতে দোষের কিছু দেখেন না বলে জানান পল্লবীর কুলসুম বেগম (২৫)। ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হওয়া এই তিন সন্তানের জননী বলেন, “পোলারা-তো দোষ করলে মাইয়াগো মারবই। এইটাতে দোষের কিছু দেহি না।”
তবে কোনো অবস্থাতেই স্ত্রীকে মারধর করার অধিকার স্বামীদের নেই জানিয়ে ড. আবুল হোসেন বলেন, “এ বিষয়ে পরিষ্কার আইন রয়েছে। কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে কোনোভাবেই পেটাতে পারেন না।”
২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর অবধি এই জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দিনাজপুর, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা—এই চারটি জেলার ২০৮টি হাউজহহোল্ডে এই জরিপ সম্পন্ন করা হয়।
এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে জরিপটি প্রকাশিত হয়। উত্তরদাতাদের বয়স ১৮ বছরের ওপরে।
জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মেয়েদের গড় বিয়ের বয়স ১৬ বছর। প্রায় অর্ধেক বিবাহিত নারী বলেছেন যে, পিতা-মাতারা তাদের সম্মতি না নিয়েই বিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া শতকরা মাত্র চার ভাগ পুরুষ বলেছেন যে, মেয়েদের ২০ বছর বয়সের পর বিয়ে হওয়া উচিত।