নব্য জেএমবির স্লিপার সেলের সন্দেহভাজন দুই সদস্য গ্রেপ্তার
2020.08.18
ঢাকা

ইসলামিক স্টেট বা আইএসপন্থী জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির স্লিপার সেলের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ দুই তরুণ গত মাসে ঘর ছেড়েছিলেন বলে জানিয়েছে তারা।
পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার দুজন হলেন, সাফফাত ইসলাম ওরফে আবদুল্লাহ ওরফে উইলিয়াম ওরফে আল আরসালান ওরফে মেহেমেদ চাগরি বেগ (১৮) ও ইয়াছির আরাফাত ওরফে শান্ত (২০)। তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে।
সিটিটিসির উপকমিশনার সাইফুল ইসলাম বেনারকে এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
“দুই তরুণ ঘর ছেড়েছিল কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জেনেছি তারা রাজনীতিবিদ ও ধনাঢ্য নাস্তিকদের হত্যার পরিকল্পনা করছিল। ওরা উগ্রবাদে দীক্ষিত হতে সময়ও নিয়েছে খুব কম, মাস দুয়েকের মতো,” বেনারকে বলেন সাইফুল ইসলাম।
তিনি জানান, স্লিপার সেলটির নাম এফজেড গ্রুপ। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর স্লিপার সেল চূড়ান্ত হামলার আগে গোপনে তাদের তৎপরতা চালিয়ে থাকে।
ওই দুই তরুণ যে দলের সদস্য, সে দলে আরও সাত–আটজন আছেন। তাঁদের গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
“গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পরে ঘরছাড়া তরুণদের খোঁজখবর করতে শুরু করেছিল পুলিশ। এক পর্যায়ে ঘরে থেকেই তারা সাংগঠনিক কাজ চালাচ্ছিল। এই তরুণদের ঘর ছাড়ার ঘটনায় নতুন করে নজরদারি বাড়াতে হবে,” জানান সাইফুল।
গত ৪ জুলাই সাফফাত এলিফ্যান্ট রোডের বাসা থেকে বের হন, আর ইয়াসির আরাফাত বের হন তাঁর কেরানীগঞ্জের বাসা থেকে। দুই পরিবারের পক্ষ থেকেই থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়েছিল।
সাফফাতের বাবা শহিদুল ইসলাম লিটন বেনারের সাথে কথা বলতে রাজি হননি। ইয়াসিরের বাবা ইউসুফ আলী হাওলাদার বিচলিত হয়ে পড়েন।
“ছেলেটা ভালো ছাত্র, কলেজে পড়ত। আমাকে বলল নষ্ট ল্যাপটপ সারাতে গুলিস্তান যাচ্ছে। আজ শুনলাম গ্রেপ্তার হয়েছে। কোথা থেকে কী হলো বুঝতে পারছি না,” বেনারকে বলেন ইউসুফ আলী হাওলাদার।
সাফফাত রাজধানীর বিসিআইসি স্কুল থেকে এ বছর এসএসসি পাস করেছেন। ইয়াছিরের ঢাকায় আজিমপুরের আইডিয়েল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল।
সিটিটিসি জানাচ্ছে, গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মোকাবেলাসহ এর পরবর্তী সময়ে পুলিশ ও র্যাব মোট ২৮টি বড়ো অভিযান চালায়। এতে এখন পর্যন্ত ৭৯ জন জঙ্গি এবং পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের আটজন নিহত হন।
পাঁচ ইউনিটের স্লিপার সেল
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার নাদিয়া ফারজানা বেনারকে জানান, দুই তরুণ উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অন্যান্য অনলাইন নেটওয়ার্কিং অ্যাপস ব্যবহার করে।
“একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ হয় অনলাইনে। তারপরই সংগঠনের কার্যক্রমকে জোরদার করতে তারা বেরিয়ে পড়ে। তাদের দিয়ে সদস্য সংগ্রহ ও নাশকতামূলক কাজ করানোর পরিকল্পনা ছিল,” নাদিয়া ফারজানা বলেন।
পুলিশ গ্রেপ্তার তরুণদের কাছে যে কাগজপত্র পেয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, সাত–আটজনের ওই দলটিতে বিশেষ বাহিনী, গুপ্তচর বাহিনী, গুপ্ত ঘাতক ইউনিট, ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার অ্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি ফোর্স এবং ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে।
বিশেষ বাহিনীর কাজ হত্যা, গুম ও কমান্ডো হামলা চালানো, গুপ্তচর ইউনিটের কাজ তথ্য সংগ্রহ ও ছদ্মবেশে শত্রুপক্ষের ভেতরে ঢুকে যাওয়া ও তথ্য পাচার এবং স্নাইপার ইউনিটের কাজ ছিল নিরাপদ দূরত্বে থেকে শত্রুকে হত্যা করা।
“ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার অ্যান্ড সাইবার সিকিউরিটি ফোর্স ইউনিট নিরাপত্তা বাহিনীর সব কৌশল আয়ত্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। দলটির ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট অস্ত্র বানানোর কৌশল আয়ত্ত করা, বানানো ও সরবরাহের দায়িত্বে ছিল,” সাইফুল ইসলাম বলেন।
দুজনের বিরুদ্ধেই কোতোয়ালী থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়েছে। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে উপস্থাপন করা হলে, আদালত তাঁদের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। পুলিশ দলটির বাকি সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছে।
সতর্ক থাকা প্রয়োজন
সাতদিনের ব্যবধানে পুলিশের হাতে আবারও সন্দেহভাজন দুই জঙ্গি গ্রেপ্তার হলেন। গত মঙ্গলবার সিটিটিসি সিলেটের পৃথক দুটি বাসায় অভিযান চালিয়ে বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করে। ওই অভিযানে যে কম্পিউটার জব্দ করা হয় সেখানে জঙ্গি তৎপরতার আলামত পাওয়া গেছে।
সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার পাঁচ আসামি রিমান্ডে তাঁদের হামলার লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে জানিয়েছেন। এ তালিকায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও, সংস্কৃতিকর্মীদের কথা জানিয়েনছে তাঁরা।
নতুন করে জঙ্গিদের এই তৎপর হয়ে ওঠায় বিপদের সম্ভাবনা দেখছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহম্মদ আলী শিকদার। যদিও তা তুলনামূলক কম বলে মনে করেন তিনি।
মোহাম্মদ আলী শিকদার বেনারকে বলেন, “জঙ্গিরা নানা সময়ে হামলা চালিয়ে নিজেদের জানান দিচ্ছে। তারা আইইডি (ইম্পোভ্রাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) ব্যবহার করছে, যা খুবই। চিন্তার বিষয়।”
“যদিও ভালো খবর হলো, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের তৎপরতা আটকে দিতে পেরেছে বলে বড় ধরনের ঘটনা ঘটেনি। হলি আর্টিজানের সময় ঝুঁকির যে মাত্রা ছিল তুলনামূলকভাবে এখন তা কম,” বলেন তিনি।
“তবে ঝুঁকি আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু ঝুঁকি কম ভাবলে তা নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি জনগনকে সচেতন হতে হবে। পরিবারকেও তৎপর ও সতর্ক হতে হবে,” মোহাম্মদ আলী বলেন।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি।