মোদি বিরোধী সহিংসতায় উস্কানির দায়ে ‘শিশুবক্তা’ মাদানীর বিচার শুরু

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.01.26
ঢাকা
মোদি বিরোধী সহিংসতায় উস্কানির দায়ে ‘শিশুবক্তা’ মাদানীর বিচার শুরু ঢাকার মতিঝিলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর বিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে রফিকুল ইসলাম মাদানীকে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। ২৫ মার্চ ২০২১।
[বেনারনিউজ]

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিরোধী উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে দেশব্যাপী রক্তাক্ত সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির দায়ে শিশুবক্তা হিসাবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানীর বিচার শুরু হয়েছে।

বুধবার ঢাকার সাইবার আদালতে পুলিশের দেয়া প্রতিবেদন গ্রহণ করে তাঁর বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়েছে বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন ট্রাইবুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম। মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে ২২ ফেব্রুয়ারি।

গত বছর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন রফিকুল ইসলাম মাদানী। যা থেকে দেশব্যাপী রক্তাক্ত সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রগতিশীল ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের ঘন ঘন অভিযোগ গঠন করা হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানো কোনো মৌলবাদী বক্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন এটিই প্রথম বলে দাবি করেছেন প্রগতিশীল ব্লগার, লেখক ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা।

প্রসিকিউটর শামীম বলেন, “পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদনে পরিষ্কারভাবে অভিযোগ এনেছেন, শিশুবক্তা মাদানী তাঁর ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে উস্কানি দিয়েছে, অপপ্রচার করেছে।”

তিনি বলেন, “একইসাথে এই শিশুবক্তার উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সারাদেশে নরক সৃষ্টি করেছে এই মৌলবাদী গোষ্ঠী।”

তবে মাদানীর আইনজীবী মো. রাব্বির দাবি, বুধবার আদালতে পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদনে যে অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো সঠিক নয়।

তিনি বেনারকে বলেন, “মাদানীর বক্তব্যকে সম্পাদনা করে আদালতে সাক্ষ্য হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।”

নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে ২৫ মার্চ থেকে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন কট্টরপন্থী ইসলামিক দলগুলো প্রথমে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও পরেরদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সবমিলিয়ে কমপক্ষে ১৭ জন প্রাণ হারান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা, বেসরকারি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় সহিংস ব্যক্তিরা।

তাদের ভাষায় নরেন্দ্র মোদি একজন মুসলমান বিরোধী মানুষ। তাঁকে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে পারে না সরকার।

অপরপক্ষে সরকার জানায়, নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী যেই দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সরাসরি ভূমিকা রেখেছে।

গাজীপুরের বাড়িয়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে মারকাজুন নূর আল ইসলামিয়া নামে একটি আবাসিক মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও পরিচালক হলেন মাদানী।

গত বছরের ৭ এপ্রিল রাতে গাজীপুরের গাছা থানায় তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলা করে র‌্যাব। একইদিন তাকে তাঁর নেত্রকোনার বাড়ি থেকে আটক করা হয়।

সাইবার ট্রাইবুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, “শিশুবক্তা মাদানীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা ও ৩১ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।”

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা অনুসারে অপরাধমূলক, হুমকিমূলক মিথ্যা তথ্য প্রচারের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির তিনবছর কারাদণ্ড ও তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয়ই হতে পারে।

আইনের ৩১ ধারা অনুসারে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় শাস্তিই হতে পারে।

ফৌজদারি আইনে বিচার দাবি

হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও বুধবার বেনারকে বলেন, “শিশুবক্তা মাদানী ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করতে গিয়ে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য ধর্মের মানুষদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চরম ঘৃণা ছড়িয়েছেন, সহিংসতায় উস্কানি দিয়েছেন।”

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো ঘৃণা-বিদ্বেষমূলক বক্তব্যে অনেক সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “যদি শিশুবক্তার বিচার করা যায় তাহলে অন্যান্যরাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়াতে ভয় পাবে।”

“মাদানীর মতো একজন মৌলবাদীর বিচার শুরু হয়েছে এটি একটি ইতিবাচক ঘটনা,” মন্তব্য করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ. সরকার বুধবার বেনারকে বলেন, “তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাঁর বিচার যথেষ্ট নয়।”

তিনি বলেন, মাদানী শুধু ডিজিটাল মাধ্যমেই বক্তব্য দিয়ে ঘৃণা ছড়িয়েছেন তা নয়, বরং “বিভিন্ন স্থানে মাঠে ময়দানে সশরীরে হাজির হয়ে মানুষকে উত্তেজিত করে সমাজে অস্থিরতা, সহিংসতা ছড়িয়েছেন। তাঁর সহিংসতার উস্কানির কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই ডজন মানুষের প্রাণ গেছে।”

“এই সহিংস ঘটনা এবং এতগুলো মানুষের জীবনের দায়িত্ব তাঁকে নিতে হবে। শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে তাঁকে বিচার করলে চলবে না,” বলেন ইমরান সরকার।

লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট বাকী বিল্লাহ বুধবার বেনারকে বলেন, “আমি বর্তমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধী। কারণ এই আইন জনগণের ডিজিটাল নিরাপত্তা কথা মাথায় রেখে করা হয়নি। এই আইনটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আমেজ, সার্বভৌমত্ব, ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি রক্ষার জন্য করা হয়েছে।”

তাঁর মতে, “মাদানীর মতো বক্তা যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন তাঁদের ফৌজদারি আইনের আওতায় এনে বিচার করা দরকার,” যাতে “যাতে এরা সমাজে ঘৃণা, উস্কানি ছড়াতে না পারে।”

বাকী বিল্লাহ বলেন, “এত দিন আমরা যা দেখেছি, প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, ছাত্রদের সামান্য কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো দেখলাম উগ্রবাদী মতামত, সহিংসতা ছড়ানোর দায়ে শিশু বক্তার মতো একজন মৌলবাদীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিচার শুরু করল।”

“শিশু বক্তার মতো অসংখ্য মৌলবাদী ব্যক্তি অনেকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা ও ঘৃণা ছড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের বিচারের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। শিশু বক্তার বিচার শুরুর কারণ হলো, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নিয়ে সরকারকে বিব্রত করেছেন। এই কাজ না করলে তার কিছুই হতো না,” বলেন বাকী বিল্লাহ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।